দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের চিরচেনা ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকার প্রথম পর্ব। যদিও তালিকাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে; তবে এটি প্রকাশ করার পর থেকে সারাদেশে কয়েক ডজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার খেতাব টানিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে সম্মানহানি করেছে, তা সমগ্র জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
যে মন্ত্রণালয় সামান্য এই কাজটি দেখভাল করতে ব্যর্থ হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছে, সেই মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে নিজেদের সাত খুন মাপ করতে চাইলেও তাতে সায় দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এই মন্ত্রণালয় শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেই বিতর্ক তৈরি করেনি, খোদ এই মন্ত্রণালয়ের ‘গুরুতর ভুল’ নিয়েই যথেষ্ট কৌতূহলের জন্ম হয়েছে।
ঠিক কারা এই মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে? আমরা যারা বিভিন্ন তথ্যের জন্য সরকারি ওয়েবসাইটগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে করি, তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইতিহাস বিকৃতি দেখলে কিছুটা হলেও ঘাবড়ে যাবেন।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিকৃত করে কার্টুন ছবিতে লেখা হয়েছে- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেবো।’ অথচ ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘রক্ত’ শব্দটি আরও শব্দের পূর্বে বলেছিলেন।
মন্ত্রণালয়ের এই ওয়েবসাইটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফুর রহমান এবং সায়রা বেগমের ঘরে জন্ম নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
জাতির পিতার বাবার নাম শেখ লুৎফুর রহমান এবং মাতার নাম সায়রা বেগম লেখা হয়েছে; কিন্তু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তার বাবার নামের বানানে লিখেছেন লুৎফর রহমান [ফ-এর ু (উকার) নেই] আর মায়ের নাম তিনি লিখেছেন সায়েরা খাতুন (বেগম নয়)।
যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল দেশের ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরা, বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, সেই মন্ত্রণালয় কি ইতিহাস নিয়ে একটুখানি পড়াশোনা করার
সময় পায়নি? খোদ এই ইতিহাসের রক্ষাকারী মন্ত্রণালয়ই তথ্য বিভ্রাট করে ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে শিখছে। যারা এই ওয়েবসাইট দেখে বঙ্গবন্ধুর জন্মপরিচিতি জানবে, তারা নিশ্চিত ভুল তথ্য জানার সুযোগ পাবে। আর সেটা করে দিচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শুধু জন্মপরিচিতিতে তথ্য বিভ্রাট করে ক্ষান্ত নন তারা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিচয়কে তারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থি এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থি ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৩৮ সালেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৩-১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ১৯৩৮ সালে কলকাতায় যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তাঁরও সাথে আলাপ করে তাকেও গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল।
আমি শুধু এই কয়েকটি বাক্যে এই গুরুত্বপূর্ণ ভুল পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আরও ঘাঁটাঘাঁটি করলে তথ্য বিভ্রাট যে পাওয়া যাবে না তা বলা মুশকিল।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীবিষয়ক বই থাকার পরও ওয়েবসাইটে কেন তথ্য বিভ্রাট তা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় আমাদের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে উজ্জীবিত করার পরিবর্তে হিতে বিপরীত কাজটিতে এগিয়ে আছে।
এই মন্ত্রণালয়ের কাজটি কী হবে, তা সরকারকে ঠিক করে দিতে হবে। দেড় দশকের বেশি সময় আগে জন্ম নেওয়ার পর কোটি কোটি টাকা বার্ষিক বাজেট নিয়েও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধানের অগ্রগতি শূন্যের ঘরে গিয়ে ঠেকেছে।
রাজাকারদের তালিকা নিঃসন্দেহে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অকাট্য দালিলিক প্রমাণ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়লে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দিতে পারে। যাদের নাম ১৯৭২ সালের দালাল আইনে এসেছে, সেটি সূক্ষ্ণ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে তুলে আনা যেত প্রকৃত রাজাকারদের নাম।
আমরা চাই না, আমাদের প্রজন্ম কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে ভুলভালভাবে জানুক। আমরা চাইব অকাট্য প্রমাণ। যে প্রমাণপত্র আমাদের ইতিহাসের স্তম্ভ্ভ হয়ে থাকবে। আর মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত