নতুন বছর ২০২০ সালের সূচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে অন্যায় ড্রোন হামলার গুপ্তহত্যা এবং চরম অশান্তি উপহার দিয়েছেন। ঘটনা যদিও ইরাকে; কিন্তু এই আগুনের তাপ প্রত্যক্ষভাবে মধ্যপ্রাচ্য তথা ইরাক-ইরান এবং পরোক্ষভাবে বিশ্বের শান্তিবাদী মানুষকে অস্থির ও চিন্তিত করে তুলেছে। চিন্তা আরেকটি আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কায়, যা হতে পারে শক্তির বিচারে অসম প্রকৃতির।
হোয়াইট হাউসে যখনই যুদ্ধবাজ ও চরম প্রভুত্ববাদী প্রেসিডেন্টের আবির্ভাব ঘটেছে তখনই বিশ্বের শান্তিবাদী মহলে চাঞ্চল্য দেখা গেছে, কী ব্যক্তিকভাবে, কী সমষ্টিগতভাবে। আইসেনহাওয়ার থেকে রোনাল্ড রিগ্যান, বুশ থেকে ট্রাম্প—এমনই এক ধারার প্রেসিডেন্ট যাঁরা বিশ্বকে তাঁদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ব্যস্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের কূট মন্ত্রণাদাতা ছোট্ট একটি বিষদুষ্ট ধর্মীয় রাষ্ট্র ইসরায়েল। বিশ্বশান্তি নষ্ট করতে, বিশেষভাবে শান্তিবাদী মুসলিম বিশ্বকে অশান্ত করতে তার কূটবুদ্ধির তুলনা বিরল। এমন প্রতিভা ক্বচিৎ দেখা যায়।
এবার ৩ জানুয়ারি (২০২০) বিনা প্ররোচনায় ইরাকে স্বনামখ্যাত ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করে ট্রাম্প নববর্ষের বিজয় সপ্তাহ উদ্যাপন করেছেন। ঘটনাটি ছিল তাঁর একক ও গোপন সিদ্ধান্তের জের। মার্কিন অন্যায়ের অংশীদার ফ্রান্স, জার্মানি প্রমুখ মিত্রদেশগুলোকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হয় যে জন্য তারা মিনমিনে আপত্তি জানিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। আগেই বলা হয়েছে ঘটনা জানা ছিল ইসরায়েলের। শুধু তা-ই নয়, তারাই সম্ভবত এ নৃশংস ঘটনার মন্ত্রণাদাতা।
ট্রাম্পের ইরানের সঙ্গে এই গায়েপড়া উসকানি মার্কিন কংগ্রেস সুনজরে দেখেনি, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি রিপাবলিকান পার্টিরও উদারপন্থীরা ট্রাম্পের এ হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছেন বলে মনে হয় না। তবে বিশ্বে এ ঘটনা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ইরানে তো সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও শাসনযন্ত্রসহ সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড ক্রোধে ফুঁসছে। এমনকি স্বাধীনতাপ্রিয় ইরাকিরাও।
প্রসঙ্গত, এ অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়টি এবং আরব-ইরানি জাতিগত ভিন্নতার দিকটি বিবেচ্য।
ইসলামের উষালগ্নে সেই যে খিলাফত নিয়ে বিরোধ এবং শিয়া-সুন্নি দুই তরিকার দ্বন্দ্ব, তা আধুনিক যুগের চিন্তাভাবনাও দূর করতে পারেনি। ইরানও তার জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও পারসিক রাজতন্ত্রী মহিমার ঐতিহ্য ভুলতে পারে না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিভেদ তাদের রাজনৈতিক ঐক্যে এক স্থায়ী কাঁটা হয়ে আছে। অদ্ভুত এক মিশ্র জনবসতি। আর এ সুযোগ বরাবর নিয়েছে এবং নিচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। করেছে তাদের স্বার্থসিদ্ধি রাজনৈতিক কূটবুদ্ধির চালে।
এই বুদ্ধির চালে একদা সেরা খেলোয়াড় ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের চাতুর্য ছিল তুলনাহীন। সেই স্থানটিতে যুক্ত হয়েছে নতুন কূটবুদ্ধির অসাধারণ খেলোয়াড় ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তাদের রাজনীতি-কূটনীতি। তাদের বড় অন্ধ সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান কোনো প্রভেদ নেই, যদি কিছু থাকে তা শুধু মাত্রার (ডিগ্রির)।
দুই.
মনে রাখতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাম্রাজ্য বিভাজনে সৃষ্ট ইরাক-সিরিয়া রাজনৈতিকভাবে একাধিক কারণে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং এ দুটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যায় শিয়ারা গরিষ্ঠ, শাসক যে মতেরই হোক না কেন। অন্যদিকে ইরান ইসলামী হয়েও জনসংখ্যা বিপুলভাবে শিয়াপন্থী। তাই কট্টর সুন্নিবাদী সৌদি আরব গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের বিরোধিতা মূলত ধর্মীয়, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক। আর ইরানে বাদশাহী রাজত্ব পতনের নৈরাজ্যে আয়াতুল্লাহ শাসিত ইরান তাদের শুরু থেকেই কট্টর ইঙ্গ-মার্কিন, বিশেষভাবে মার্কিনবিরোধী।
এ দ্বন্দ্বটা চলে আসছে ১৯৭৯ সাল থেকেই। আর সেই সূত্রে মার্কিন নির্দেশে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তির অজুহাতে। মাঝে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ইরান-ওয়াশিংটন দ্বন্দ্বে কিছুটা শান্তিচুক্তির সুবাতাস বইলেও যুদ্ধবাজ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বিপরীত ধারায় চলতে শুরু করে। কথায় কথায় হুমকি, পাল্টা হুমকি।
দীর্ঘ সময়ের বিরোধিতার জের ধরে পারমাণবিক শান্তিচুক্তির নমনীয় সম্পর্ককে নষ্ট করতে যুদ্ধবাজ ট্রাম্পের এই অন্যায় হত্যাকাণ্ড। তাদের এই রকেট হামলায় অন্ততপক্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন বলে ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তারা প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ নিয়ে অতীব উত্তেজনায় ভুল করে ইউক্রেনের বিমান ভূপাতিত করে অনেকটা আত্মঘাতী পদক্ষেপই নিয়েছে। ভয়ানক চাপে এখন ইরান।
ঠাণ্ডা মাথার খুনি ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবেলায় খামেনির উচিত ছিল ধীরস্থির পদক্ষেপ। উত্তেজনা মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বিভ্রান্ত করে। এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। কারণ ওই বিধ্বস্ত বিমানে ইরানি যাত্রী ছিল অনেক। তাদের মৃত্যু ইরানি সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল এবং খামেনি সরকারের পদত্যাগ দাবি। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে খামেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে হয়তো খামেনিবিরোধী রাজনীতিকদের উসকানি ও ইন্ধন রয়েছে। রাজনীতি এমনই এক স্বার্থপর বিষয়, যা অনেক সময় দেশাত্মবোধকেও গ্রাস করে।
স্বভাবতই ট্রাম্পের দুই দফা জয়। প্রথমত ইরানের এক প্রবল শক্তিমান ব্যক্তিকে হত্যা করে, দ্বিতীয়ত খামেনির স্বকৃত ভুলে দেশে ও বাইরে তাঁর বিরোধিতা সৃষ্টির কারণে। হয়তো তাই আপন মানসিক শান্তি ও পরিতৃপ্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। এ ঘটনা কি তার অভিশংসনের ওপর প্রভাব ফেলবে? ইতিবাচক, না নেতিবাচকতায়।
কথাটা বলছি এ জন্য যে মার্কিন জনমত তো, দু-এক স্থানে ব্যতিক্রম বাদে সাধারণত হুজুগে। অপপ্রচারে ভুলতে তারা অভ্যস্ত। অবশ্যই আবার ভিয়েতনামযুদ্ধ-বিরোধিতা এবং অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনও সত্য। তবে ইরানের ক্ষেত্রে মার্কিন জনমত বিরোধিতারই পক্ষে যদিও মানুষ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। কারণ যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জন্য নানাবিধ দুর্ভোগ বয়ে আনে, জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করে তোলে।
তিন.
সোলাইমানির মৃত্যু নিঃসন্দেহে ইরানের জন্য, তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিচারে বিরাট ক্ষতি। তাই দেখা গেল তাঁর জানাজায় ইরানে লাখো মানুষের শোকার্ত উপস্থিতি। এমনকি ইরাকে অনুষ্ঠিত তাঁর জানাজায়ও অনুরূপ বিপুলসংখ্যক শোকার্ত মানুষের ঢল। কারণ ইরাককে কট্টর সুন্নিপন্থী নিষ্ঠুর ঘাতক চরিত্রের আইএসমুক্ত করতে সোলাইমানির অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তাই ইরাকি শিয়া জনগোষ্ঠীর কৃতজ্ঞতা ছিল সোলাইমানির প্রতি। এ ঘটনা পছন্দসই ছিল না ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের।
প্রশ্ন : এ কারণেই কি যুদ্ধবাজ ট্রাম্পের সোলাইমানি হত্যার পরিকল্পনা কার্যকর করা? এমন সম্ভাবনাই যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। প্রসঙ্গত প্রশ্ন থাকে, সোলাইমানির কৃতী ব্যক্তিত্বের কি আপন নিরাপত্তা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল না? এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা গেছে আরব বুদ্ধিমত্তা চতুর ইসরায়েলি বুদ্ধির কাছে হার মেনেছে। যেমন ইয়াসির আরাফাত। ইরানও কি শেষ পর্যন্ত সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছে?
এখন বড় আলোচ্য বিষয় বিশ্ব বিশ্লেষকদের : ইরানের এই প্রতিশোধমূলক দুটি ঘটনার পর আপাতত জয়লাভ সত্ত্বেও যুদ্ধোন্মাদ ট্রাম্প কি চুপচাপ বসে থাকবেন? তাঁকে আপাতত শান্তির কথা, অর্থাৎ যুদ্ধ নয়, এমন কথা বলতে শোনা গেলেও সেসব অমিয় বাণীর ওপর একেবারেই নির্ভর করা চলে না। কারণ ট্রাম্প কোনোভাবেই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নন। তাঁর কথায় ও কাজে প্রচণ্ড রকমের অমিল প্রায়ই দেখা যায়।
তাই গোটা শান্তিপ্রিয় বিশ্ব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতায় ভুগছে আবার একটা আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে কি না সেই ভয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্পর্শ করবে—সন্দেহ নেই। তা ছাড়া বিশ্বশান্তির বিষয়টি তো সবারই বিবেচনায় রয়েছে। আমরা কেউ যুদ্ধ চাই না। এরই মধ্যে ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে বিশেষ রকম নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশ দিয়েছেন বলে প্রকাশ।
দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ব্যস্ত ঘটনার অনুপুঙ্খ বিচারে এবং এর পরিণামের কথা ভেবে। সম্ভবত বিশ্বশান্তির কথা ভেবেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল ট্রাম্পের ভূমিকা সুনজরে দেখছে না। এমন মানসিকতা কিছুটা হলেও মার্কিন রাজনীতির নীতিনির্ধারক মহলে। সেই সূত্রেই কি একটি যুক্তিসংগত সংবাদ : ‘ট্রাম্পের যুদ্ধ ক্ষমতা খর্বের প্রস্তাব (যুক্তরাষ্ট্রের) প্রতিনিধি পরিষদে অনুমোদিত’।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে সিনেটে উচ্চ পরিষদে পাস হওয়ার ওপর। তবু এ সিদ্ধান্তটি যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের প্রত্যাশা—‘যুদ্ধংদেহি’ ভাবটির শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি। তবু প্রশ্ন : ইরান তার ক্ষতের যন্ত্রণা কিভাবে ভুলবে? অন্যদিকে ট্রাম্প ইরানকে বিপর্যস্ত করবেই—এমন ধারণা ট্রাম্পের স্বভাবগত কারণে।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> নতুন বছরে পুরনো চ্যালেঞ্জ সফল মোকাবেলা দরকার