প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বৈরী পরিবেশে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি এবং ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই। দেশে উন্নতি হচ্ছে কিন্তু আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বিশেষ করে পঁচাত্তরের পর বিরাট অবদান রেখে গেছেন সেই সমস্ত ছাত্র নেতারা চলে (মারা) যচ্ছেন।
রোববার জাতীয় সংসদে চলমান একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য আব্দুল মান্নানের মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
আলোচনার পর শোক প্রস্তাবটি সংসদে গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মো. নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, মৃণাল কান্তি দাস, মোসলেম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম বাবু, আনোয়ার আবেদীন খান, তাজুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির মশিউর রহমান রাঙ্গা, পীর ফজলুর রহমান, জাতীয় এক্যফ্রন্টের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার হাতে গড়া ছাত্রনেতারা যারা সামনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবে, আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, ভবিষ্যতে আমরা যখন থাকব না, এরাই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার কষ্ট হয় যখন আমার চোখের সামনে ওরা চলে যায়, যা সত্যিই খুব দুঃখজনক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মনে একটা কষ্ট নিয়ে আজ দাঁড়াতে হলো। পরপর তিনজন সংসদ সদস্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি ১৯৮১ সালে ফিরে আসার পর মান্নানকে ছাত্রনেতা হিসেবে পেয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালে তাকে ছাত্রলীগের সভাপতি করি। ছাত্রলীগের সভাপতি করার একটা ঘটনা আছে। যাদের ছাত্রলীগের সভাপতি করা হতো আমি তাদের ইন্টারভিউ নিতাম, একা একা।
সংসদ নেতা বলেন, অনেকের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে যখন মান্নানকে বলেছি- যদি তোমাকে আমি না বানাই, তাহলে তুমি কী করবে? অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে দিত। কিন্তু একটি ছেলেকে পেয়েছিলাম সে বলে দিয়েছিল না বানালে কিছু করার নেই, আমি আপনার সঙ্গে রাজনীতি করে যাব। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকেই বানাব। ওই সময়টা ছাত্রলীগের খুব খারাপ সময় ছিল। অনেকেই ছাত্রলীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিল ১৯৮২ সালে। সে কারণে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করার খুব দরকার ছিল এবং তার সেই সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। সে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।
তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে তাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসি, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। বগুড়ার মতো জায়গায় ওকে নমিনেশন দিলাম। খুব কঠিন জায়গা ছিল, এলাকাটা দুর্গম এবং রাস্তাঘাট ছিল না। খুবই অনুন্নত একটি জায়গা। সেখানে তাকে যখন নমিনেশন দিলাম, মান্নান সেখানে থেকে জিতে আসল, পর পর তিনবার সেখান থেকে সংসদ সদস্য।
স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ঠিক মৃত্যুর দুইদিন আগে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলল। আমাদের সেন্ট্রাল কমিটিতে নানক আসছে, ও আসতে পারেনি। বোধহয় মনে একটু দুঃখ ছিল। আমি বললাম আমি তো তোমাদের কাউকে ফেলে দেইনি। তুমি আওয়ামী লীগে ছিলে এবং তোমাকে আমি নমিনেশন দিয়েছি, সংসদ সদস্য হয়েছ। কথা বলার সময় দেখলাম তার শরীরটা একটু খারাপ। আমি ওকে বললাম তোমার শরীর মনে হয় ভালো না, তুমি একটু ভালোভাবে চিকিৎসা কর। ঠিক তারপরই হাসপাতালে ভর্তি।
তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর আমি প্রতিদিন একবার ডাক্তার সৌরভের সঙ্গে কথা বলতাম, যেদিন মারা গেল তার আগের দিন রাত ৯টার সময় ডাক্তার সৌরভের সঙ্গে কথা বললাম। প্রতিদিন সৌরভের সঙ্গে কথা বলে ওর স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতাম। ওইদিনই ডাক্তার বললেন আপা ওর শরীরের অবস্থা ভালো না। ওকে আমরা কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না। শরীরটা খুবই খারাপ। এমন অবস্থা ছিল যে, আমি বলেছিলাম ওকে যদি বাইরে পাঠানো যায়, ডাক্তার বলল যে বাইরে পাঠানোর অবস্থা নেই। পরদিন সকাল বেলায় মৃত্যুর খবর। এটি সব থেকে দুঃখজনক।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ছাত্রজীবন থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, জিয়াবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়াবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে বহু ছাত্রনেতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। একটা বৈরী পরিবেশে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি এবং ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী সরকার আছে বলেই বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্ত ছাত্র নেতারা দুঃসময়ে বিশেষ করে পঁচাত্তরের পর বিরাট অবদান রেখে গেছেন। অনেক কাজ করে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটা ক্ষেত্রে মান্নান অত্যন্ত দক্ষ ছিল, মেধাবী ছিল। যখন দলের প্রচার সম্পাদক ছিল, তখন প্রতিটি লিফলেট থেকে শুরু করে বিবৃতি লেখা আমি নিজে বসে থেকে ওকে দিয়ে লেখাতাম। যখন যে কাজ দিয়েছি প্রত্যেকটা দক্ষতার সঙ্গে করেছে। আমার হাতে গড়া ছাত্রনেতারা এরাই আগামীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যতে আমরা যখন থাকব না। আমার চোখের সামনে ওরা চলে যায়, সেটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। ইউনুস মারা গেল, মান্নানের মৃত্যু, বাগেরহাটের মোজাম্মেল হক সাহেবের মৃত্যু। বাপ্পা মারা গেল। এটা আসলে দলের জন্য তো বটেই দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আমির হোসেন আমু বলেন, আবদুল মান্নানের অকালমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অসম্ভব সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি ক্ষুরধার লেখক ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে তিনি বৈরী অবস্থায় দক্ষতার সঙ্গে সারা দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক, অসম্ভব স্নেহ ও ভালোবাসতাম। সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে রাজপথে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, কৃষকের ঘর থেকে উঠে আসা সন্তান আবদুল মান্নান। ছাত্রলীগকে অত্যন্ত কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে শক্তিশালী করেছিল এই কৃষিবিদ নেতা। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় তাকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন। বগুড়ার মতো জায়গায় তিনবার এমপি হয়েছেন।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন নিবেদীত কর্মী ছিলেন আবদুল মান্নান। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল মান্নান বিপুল ভোটে ভিপি হওয়ায় জেনারেল জিয়া তাকে হত্যার জন্য গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। আবদুল মান্নান ওই হামলায় বেঁচে গেলেও সেখানে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল আবদুল মান্নান অসম্ভব মেধাবী ও সাহসী রাজনীতিবিদ ছিল।
ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আবদুল মান্নানের সঙ্গে আমার পরিচয়। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আইয়ুববিরোধী, মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে ছিলেন আবদুল মান্নান। জিয়া-এরশাদকে কোনোদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি এই লড়াকু ছাত্রনেতা।
গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, ’৭৫ পরবর্তী চরম দুঃসময়ে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন প্রয়াত আবদুল মান্নান। সারা দেশ ঘুরে বেরিয়ে ছাত্রলীগকে শক্তিশালী করে স্বৈরাচারি জিয়া-এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছেন।