উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী : শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতিঘর

হেলাল উদ্দিন হৃদয়

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

ভিড়ের মধ্যে যে-মানুষ হারিয়ে যেতে চান, আসলে সেই মানুষকেই ভিড়ের মধ্যে সহজে চেনা যায়। চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের চারপাশে একটু তাকালে সংখ্যায় অল্প হলেও এমন কিছু মানুষের উপস্থিতি এখনও আমরা দেখতে পাই, যাঁরা মানুষের জন্য মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যান। এমন স্বল্পসংখ্যক মানুষদের অন্যতম র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, মানুষের ভিড়ে যাঁকে সহজে চেনা যায়। সাধারণ, অনাড়ম্বর, অন্তরের ঔজ্জ্বল্যতাকে আটপৌরে আস্তরণে ঢেকে রেখেছেন যিনি সবসময়। সহজেই তিনি যে-কাউকে ভালোবাসতে পারেন। এই জাদু সাধারণত সকলের থাকে না, যাঁদের থাকে তাঁরা সত্যিই বিরলপ্রজ। তিনি নিঃসন্দেহে সেই বিরলপ্রজদের একজন। নানা ধরনের লোকজন—সমাজের নানা স্তর থেকে ওঠে আসা, আচরণে-রুচিতে-বিচারে অনেক তফাত—কিন্তু এঁদের সবাইকেই তিনি চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেন। আকর্ষণ করেন তাঁর অসাধারণ সাধারণত্ব দিয়ে। যারা তাঁর কাছে আসেন, কেমন করে তারা যেন বুঝে যান এই মানুষটির মধ্যে কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই, এই মানুষটির কাছে তাই খোলাসা হওয়া যায়, অকপট কথা বলার মর্যাদা দেবেন এই মানুষটি, অকপট মন নিয়ে যে-কথাগুলো বলা হবে, তা তিনি শুনবেন—অকপট মন নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে; শোনার পর রেখে-ঢেকে কিছু বলবেন না, সরল ভাষায় সরল উপদেশ দেবেন, অকপট সাচ্চা উপদেশ। ভর্ৎসনার প্রয়োজন হলে উপদেশের সঙ্গে তা-ও জড়িয়ে থাকবে অকপটভাবেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যা থাকবে তা হলো ভালোবাসা—নিখাদ ও অতল ভালোবাসা। যে-মানুষ নিখাদ ভালো, এমন করে ভালোবাসা কেবল তিনিই ছড়িয়ে দিতে পারেন।

উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও তা পারেন। একজন ভালো নেতা হতে গেলে সর্বাগ্রে ভালো মানুষ হতে হয়। ভালো মানুষ, যিনি নিজের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির প্রসঙ্গ দূরে সরিয়ে রেখে পড়শীর শুভাশুভ নিয়ে সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে বেশি ভাববেন। যিনি নিজেকে কখনো জাহির করবেন না। অন্যকে যিনি ভালোবাসা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে অনুপ্রাণিত করবেন। যিনি আদর্শে স্থিত থাকবেন, কিন্তু আদর্শের সঙ্গে যারা একাত্ম নন, তাদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন না। যিনি সৌভাগ্যবান ঋতুতে হাজির হওয়া অনুরাগীদের ভিড়ের ঠেলায় সংকটের দিনের বন্ধুদের হারিয়ে যেতে দেবেন না। যাঁর সকলের সঙ্গেই আলাদা করে কথা বলার সময় আছে, প্রত্যেকের সংসারের খুঁটিনাটি খবর নেওয়ার সময়, অসুখের খবর-আনন্দের খবর নেওয়ার সময়; যিনি অপরের দুঃখকে ভাগ করে নিতে জানেন, যেমন জানেন অপরের আনন্দে সমান দীপ্যমান হয়ে উঠতে। এসবই তো একজন ভালো মানুষ, একজন ভালো নেতার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতি যেসব মানুষ বা যেসব নেতার চরিত্রে রয়েছে, তাঁরাই জনতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে ভালোবাসেন। কিন্তু ওই একই কারণেই জনতার ভিড়েও চোখে পড়েন এই মানুষগুলোই। তাঁদের ত্যাগ দিয়ে, অধ্যবসায় দিয়ে, বিনয়-নম্রতা-আদর্শনিষ্ঠা-কর্তব্যপরায়ণতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে জনতাকে সংহত, সংঘবদ্ধ করে তুলেছেন তাঁরাই তো। নিজেদের কথা আলাদা করে তাঁরা কোনোদিন বলেন না, তাঁদের বিবেচনায় তা অবিনয় বলে মনে করেন তাঁরা। অথচ তাঁদের ব্যক্তিগত কাহিনি নিছক তাঁদেরই কাহিনি নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সুদীর্ঘ আন্দোলনের কাহিনি, সংগঠন তৈরির কাহিনি, অত্যাচারিত-নিপীড়িত মানুষকে ভালোবাসার কাহিনি; অনেক দুর্যোগ, অনেক সংকট, অনেক সাহসের কাহিনি, সাময়িক পরাজয়ের কাহিনি, সেই সঙ্গে অনেক দায়বদ্ধতা-শপথ-প্রতিজ্ঞার কাহিনিও। তেমনই এক জীবন্ত কাহিনির নাম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। যিনি তাঁর স্বীয় অনন্যসাধারণ কর্মশক্তি বলে অবলীলাক্রমে অসংখ্য অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু কখনওই তিনি সাফল্যের গর্বে আত্মহারা হননি।

এমনকি কেউ তাঁর সামনে ঐ-সকল প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, ‘আমি যা করতে চাই, তার তুলনায় যা করেছি তা কিছুই নয়’। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও চিন্তাপ্রণালীর আশ্চর্য শৃঙ্খলাবোধ এবং অগ্রগতির অদম্য কর্মস্পৃহা তাঁকে কখনও অলস থাকতে দেয় না। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ততোধিক ক্ষিপ্রতায় তা কার্যে পরিণত করার শক্তি তাঁকে একজন সফল মানুষ ও ভালো নেতার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ চিনতে তাঁর কখনওই ভুল হয় না। তাঁর দলের এবং নিজ নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ মানুষই তাঁর সুপরিচিত। জনগণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে রহস্যময় জীবনের মোহজাল দ্বারা জনমণ্ডলিকে আচ্ছন্ন করার মতো মনোবৃত্তি তাঁর নেই, কখনও ছিলও না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকেও আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই তিনি সবার সঙ্গে মিলেমিশে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেন। আলাপ-আলোচনায় সদালাপী ও হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি কোনো বিষয় আলোচনাকালে যখন বক্তার ভূমিকায় থাকেন, অথবা কোনো যুক্তি খণ্ডন করেন, তখন তাঁর জ্ঞানের ঔজ্জ্বল্যে প্রতিটি কথা শাণিত তরবারির মতো ঝলসে ওঠে। তিনি সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন, যাঁরা একই সঙ্গে জাতির জনক ও তাঁর কন্যাদ্বয়ের অবারিত স্নেহে সিক্ত হয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু-তনয় শেখ কামালেরও ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্তরে-বাহিরে শতভাগ সৎ মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি তা-ই। তাঁর সমগ্র কর্ম, চিন্তা-চেতনা, আরাধনাজুড়ে কেবল মানুষের কল্যাণ। মানুষের চেয়ে বড় কিছুতে তিনি বিশ্বাস করেন না। সারাজীবন প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী নানা পরিচয়ে বিধৃত—স্বনামধন্য আমলা, স্বচ্ছ রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সমাজসেবক, বিদ্যোৎসাহী, সংস্কৃতিসেবী ও মুক্তবুদ্ধির চিন্তক। কোন পরিচয়ের চেয়ে কোন পরিচয় বড়, সেটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষপর্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী ত্যাগী ছাত্র ও নেতা-কর্মীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। নিজের কণ্ঠকে উচ্চারিত করেছিলেন স্বতন্ত্রভাবে।

সত্য ও ন্যায়ের প্রতি স্থির, অবিচল এ মানুষটি দেশ, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ধারণাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতে পারঙ্গম ছিলেন ছাত্রাবস্থাতেই। ফলে তিনি তাঁর সময়ের অনেককে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন ব্যক্তিগত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে সম্বল করে। আবার, এ-ও সত্যি যে, গত প্রায় চার দশকে অনেকেই অর্থ-বিত্তে যতটা এগিয়ে গেছেন, ক্ষমতার আস্বাদনে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তজন হওয়া সত্ত্বেও তিনি ততোটাই পিছিয়ে রয়েছেন। এজন্য কখনওই তাঁর মধ্যে ন্যূনতম আক্ষেপ বা আফসোস নেই। আসলে কোনো কিছুর প্রত্যাশায় কিংবা কোনো কিছু প্রাপ্তির জন্য তিনি কিছু করেনওনি। যে মানুষগুলো এখন দেশ পরিচালনা করছেন, তাঁরা সবাই জানেন, এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-এর প্রতিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুভ বোধ সৃষ্টিতে তাঁর কী অবদান। শুচিশুদ্ধ, রুচিঋদ্ধ এ মানুষটি জীবনভর মঙ্গলের, কল্যাণের, মানবিকতার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এবং শুভবুদ্ধির প্রদীপ জ্বেলে যাচ্ছেন। পাকিস্তান আমলে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর দীর্ঘ গন্তব্যের পথচলা শুরু। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসন থেকে টানা তিনবারের সাংসদ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আজ ২০ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েই এ নিবন্ধ।

এমন একজন সজ্জন মানুষ সম্পর্কে কিছু লিখতে বসে যে কাউকেই প্রথমেই যা চমৎকৃত করবে তা হলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের বৈচিত্র্যতা, ব্যাপকতা ও বহুমুখীনতা। বর্ণময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন গতানুগতিকতা পরিহার করতে। আপাদমস্তক একজন রাজনীতিক হয়েও রাজনীতির বৃত্তকে পাশে রেখে কীভাবে সাংস্কৃতিক চিত্তকে ধারন করে মানুষের অধিকার আদায় ও রাজনৈতিক ধারায় নিজেকে মেলে ধরা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর উন্মুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির গোড়াপত্তনে জাতির জনক যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তারই আদর্শিক সন্তান মোকতাদির চৌধুরী। সবসময় তিনি উপলব্ধি করেন, যে কোনো মহৎ কাজ পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত সুসম্পন্ন হতে পারে না। এজন্যেই তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ বিনির্মাণ, শিক্ষার প্রসার এবং সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায়ও অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের যথেষ্ট মূল্যায়ন ও সম্মান করেন, তাঁদের প্রতি তাঁর রয়েছে প্রগাঢ় ভালোবাসা। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন ও পরিচর্যায় উল্লেখযোগ্য সহযাত্রী তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন চত্বরটিকে ‘শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষাচত্বর’ এবং সবচেয়ে বড় মিলনায়তনটিকে ‘সুরসস্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে নামকরণ করা এর উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।

এ-তো গেল তাঁর নিজ এলাকার কথা। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দের একটি স্মৃতিফলক ছিল ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ রেলব্রিজসংলগ্ন শ্মশানঘাটে। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী স্মৃতিফলকটি গুঁড়িয়ে দিলে দীর্ঘদিন এটি পড়ে ছিল চরম অবহেলায়! কবিদের সংগঠন ‘বাঙ্ময়’-এর ব্যানারে ময়মনসিংহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত আলেকজান্ডার ক্যাসেলের পাশে শিক্ষাবিদ-লেখক-গবেষক অধ্যাপক যতীন সরকার ও কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে ফলকটি পুনঃস্থাপন করেন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। একই ব্যানারে ঢাকার শাহবাগে বর্ণিল এক কবিতামেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল চিন্তাশীল সাময়িকী ‘মত ও পথ’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০০৯-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনকের শাহাদত বার্ষিকীতে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশনার যাত্র শুরু করে ‘মত ও পথ’, গতানুগতিকতার বাইরে, ভিন্ন ধাঁচের একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পাক্ষিক সাময়িকী। তখন থেকেই বাংলাদেশের সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থেই ভিন্ন ধাঁচের একটি পত্রিকার যাত্রা শুরু, যার প্রকাশনা নিরবচ্ছিন্নভাবে আজও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের চিন্তাশীল সাময়িকীর ইতিহাস লিখতে গেলে নিরপেক্ষ যে-কোনও ইতিহাসবিদের পক্ষেই পাক্ষিক ‘মত ও পথ’কে বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। আরও স্পষ্ট করে বললে, ‘মত ও পথ’কে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সাময়িকপত্রের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা যাবে না। কেননা প্রকাশনার সৌকর্যতা ও ধারাবাহিকতায় ‘মত ও পথ’ নিজেই এখন একটি ইতিহাস।

২০১৬’য় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব’। জেলা শহর ও তাঁর নিজ গ্রামে একযোগে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী এ উৎসব। বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙলাভাষী বিভিন্ন রাজ্যের বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রায় শতাধিক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক-ইতিহাসবিদ-শিক্ষাবিদ-ভাষাবিদদের সম্মিলন ঘটে ওই উৎসবে। যার পুরোভাগে ছিলেন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তিনি ছিলেন এর একক পৃষ্ঠপোষক। শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই যখন মনে করেন সংস্কৃতিচর্চার মূল কেন্দ্রই হচ্ছে ঢাকা এবং প্রান্তিক অঞ্চলের অনেক সংস্কৃতিকর্মীই যখন ঢাকামুখি তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য, তখন কেন্দ্রে থেকেও উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী দেশজ সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে। তিনি মনে করেন, এর জন্যে সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে প্রান্তিক জনপদে। এ ভাবনা থেকেই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুকে যখন ভয়ানক এক কৃষ্ণপক্ষ বিরাজমান, মৌলবাদী তাণ্ডবে গোটা শহর যখন বিধ্বস্ত, সেই বেদনার বিতৃষ্ণার মাঝেও তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ও ইচ্ছায় এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় তাৎপর্যপূর্ণ বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসবটি। বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় প্রয়াস হলেও প্রগতিশীল চেতনার সার্বিক চিন্তার প্রকাশ যেমন ঘটেছে তাতে, তেমনি প্রকাশ ঘটেছে সংস্কৃতির প্রতি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার বিষয়টিও। আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ, অভিজাতও বটে। বিস্তৃত পরিসরে এখানে তুলে ধরা হয় বঙ্গদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে। আকালের কালে আয়োজনটির বিশেষ মূল্য বারবার ফিরে দেখার দাবি রাখে। কোনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিই যে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমানতাকে দমিয়ে রাখতে পারে না, তার প্রমাণ বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব। সত্য সুন্দরের এই উৎসবের মাঝেই ফুটে ওঠে বাংলাদেশ। যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে জঙ্গি গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে সুন্দরের বিরুদ্ধে, তখন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে রুখে দাঁড়ায় শিল্প। বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব ছিল সেই শিল্পের এক সম্মিলিত প্রয়াস। উৎসব উপলক্ষে একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনাও বের করা হয়। ৪৮০ পৃষ্ঠার এ-সংকলনটিতে বঙ্গ-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে বাংলা ভাষার বিখ্যাত বহু লেখকের লেখা স্থান পায়, যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণে রাখার মতো। ঢাকার বাইরে কোনো মফস্বল শহরে এমন আয়োজন বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ছাড়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সহজও নয়। যাঁদের প্রেম-শ্রম ও বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা আয়োজনটিকে সফল করেছে, তাঁদের মধ্যে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী অগ্রগণ্য। তীক্ষ্ণ কিন্তু স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাবলীল রচনাশৈলীর মাধ্যমে তিনি পাঠকবর্গকে এমন কয়েকটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন যা লেখক হিসেবে তাঁকে তাদের চিত্তে সমাদৃত ও সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী যে আত্মত্যাগ-নিষ্ঠা-বিনয়-দায়বদ্ধতা-সততা-মমতা-ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখছেন এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর যে অনিবার্য উপস্থিতি ও অঙ্গীকার, বর্তমান সমাজের নিরিখে তার তাৎপর্য সীমাহীন। আর এভাবেই তিনি বিপুল কর্মযজ্ঞের গুণে হয়ে উঠেছেন, স্বকালের শিক্ষা-সংস্কৃতির বাতিঘর।

লেখক : সংস্কৃতিকর্মী। সাংস্কৃতিক সংগঠক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে