শুরুটা তো যুগ-যুগান্তরে। আধুনিক জীবনবোধ, নারী-পুরুস-সাম্য ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, মাতৃমূল্যে বিবেচনা ইত্যাদি কারণে নারী ধর্ষণে ছেদ পড়া উচিত ছিল অত্যাধুনিক যুগে পৌঁছে। ছেদ না হলেও এর দৃশ্যমান হ্রাস প্রত্যাশিত ছিল। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে, তেমনি বিশেষভাবে মানবিক মূল্যবোধে আদর্শিক ধারায় রণাঙ্গনে অর্জিত বাংলাদেশে। যে রণে নারী-পুরুষ লড়াই করেছে সহমর্মিতায়।
কিন্তু বড় অপ্রত্যাশিত, বড় বেদনাদায়ক ঘটনা যে কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সমাজকে সর্বাংশে মানবিক মূল্যবোধে শিক্ষিত করে তোলেনি। দুর্নীতি থেকে সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি থেকে জঘন্যতম সব আচার ও অপরাধ আয়ত্ত করেছে বাংলাদেশি সমাজের নানা শ্রেণির সদস্যদের অংশবিশেষ। আরো মর্মান্তিক ঘটনা যে দিন দিন তা বেড়ে চলেছে। বাড়ছে শিক্ষার্থী থেকে সমাজের নানা স্তরে, নানা শ্রেণিতে। মাদকাসক্তি এ দুর্বৃত্তপনায় সহায়ক শক্তি বা প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু নাগরিক সমাজের শ্রেণিবিশেষই নয়, রাজধানী ও তার সন্নিহিত এলাকা থেকে শহর হয়ে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এ জঘন্য আচরণের প্রকাশ যা কিছুকাল থেকে ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। এ মানসিক ব্যাধি সম্প্রতি মহামারির রূপ ধারণ করেছে। কয়েক বছর ধরে এর বাড়ন্ত রূপের প্রকাশ। এ অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ বা কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে অবহেলা বা দীর্ঘসূত্রতা মহামারি রূপের প্রধান কারণ বলে আমাদের বিশ্বাস।
অবশ্য স্বীকার্য যে এ ক্ষেত্রে আইন আছে, বিশেষ বিচারব্যবস্থা আছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ থাকলেও তা ব্যাপকভাবে, দৃষ্টান্তমূলক চরিত্র নিয়ে কমই দেখা যায়। স্বভাবতই অপরাধপ্রবণদের মধ্যে দুর্বৃত্তপনায় উৎসাহ বাড়ে, আইনের ভয় তাদের নারী নির্যাতন থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। আর মাদকাসক্ত হলে তো কথাই নেই। কোনো শাস্তির ভয় তাকে অপরাধ সংঘটন থেকে পিছু হটাতে পারে না। তাই বিশ্বের জঘন্যতম ঘটনাগুলোর অন্যতম নারী ধর্ষণ, শিশুকন্যা ধর্ষণ বাংলাদেশি সমাজে দ্রুত হারে ঘটে চলেছে। বিপরীতে এসব ঘটনার প্রতিকারে শাসনব্যবস্থা ধীরচালে, স্বভাবসুলভ ঢিলেঢালা নিয়মতান্ত্রিকতায় এগিয়ে চলেছে। তাতে কখনো সঠিক বিচার সম্পন্ন হয়, কখনো হয় না যথোচিত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে। কখনো এমন ঘটনা দেখা গেছে, ধর্ষক জামিনে খালাস পেয়ে নিত্যনতুন ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।
দুই .
কিছু জরিপে দেখা গেছে, গত বছরটি (২০১৯) নারী-শিশুকন্যা ধর্ষণে অবিশ্বাস্য মাত্রায় মাইলফলক রচনা করেছে। সেই সঙ্গে ধর্ষণোত্তর হত্যার ঘটনাও। নারীর যৌন নিরাপত্তা অপহৃত। এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে নারীর যৌনসত্তা ও জীবন নিরাপদ। মনে হয়, যেন একধরনের পৈশাচিক উন্মাদনা এজাতীয় অপরাধের পেছনে কাজ করছে। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রশাসন নারীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী করবে তারা? কোথায় যাবে তারা? কিছুদিন আগে একটি দৈনিকের সংবাদে পড়েছিলাম : ‘কর্মস্থলে এবং গৃহেও নারী নিরাপদ নয়।’ নয় পথে, যাতায়াতে, রাজপথে বা সড়কে, বাসে বা যানবাহনে। বলতে হয় এ কোন বাংলাদেশি সমাজে বাস করছি আমরা? সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, ধর্মীয় শিক্ষায়তন তথা মাদরাসায় ছাত্রীরা সর্বাধিক সংখ্যায় ধর্ষিত। জরিপ তা-ই বলে। কী জবাব দেবেন ইসলামী ধর্মগুরুরা, যাঁরা ইসলামী কানুন, শরিয়া প্রবর্তনে জিহাদ করতেও প্রস্তুত। আর ওই ধর্ষকরা সবাই মাদরাসা শিক্ষক ও অধ্যক্ষ, যাঁরা সর্বোচ্চ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত।
নারী ও শিশুকন্যা ধর্ষণ সম্পর্কে কেউ কেউ আশাবাদী ছিলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের নানা মাত্রিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় নতুন বছর ২০২০-এ, মুজিববর্ষে নারীর প্রতি, শিশুকন্যাদের প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। কিন্তু বৃথা আশা। দুর্বৃত্তরা চরম আঘাত ছাড়া দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হয় না। হয়নি যে তার প্রমাণ এই বিশেষ বর্ষের প্রথম মাসের শুরুতেই ধারাবাহিকভাবে এতগুলো নারী ধর্ষণ, তরুণী ধর্ষণ ও শিশুকন্যা ধর্ষণের ঘটনা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে ক্ষমতাসীন শাসক মহলের সর্বোচ্চ স্তরে শোরগোল শুরু হয়েছে।
ঘটনার সূচনা কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের মাধ্যমে, যা শিক্ষার্থী মহলে তীব্র ও ব্যাপক প্রতিবাদী বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। তারা ধর্ষকের আশু গ্রেপ্তার ও তার চরম শাস্তির দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। বিচলিত সরকার। স্বভাবতই তৎপর পুলিশ বাহিনী এবং ঠিকই গ্রেপ্তার ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ মজনু, যথারীতি তার স্বীকারোক্তি।
আর তাই নিয়ে সংসদে মহা তোলপাড়। লক্ষ করার বিষয় হলো তাদের কেউ কেউ ওই ধর্ষকের চরম শাস্তি উপলক্ষে ধর্ষকমাত্রকে ‘এনকাউন্টারে’, কারো ভাষায় ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘোষণা দিয়েছেন উত্তেজিত ভাষ্যে। এককথায় বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ডের পক্ষে রায় ঘোষিত হয়েছে সংসদের আইনপ্রণেতাদের কারো কারো পক্ষ থেকে। আর তা নিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা এবং গণতন্ত্রী রাজনৈতিক মহলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা।
এসব মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যের ডামাডোলের বিশদ বিবরণে যাবার আগে দেখে নেওয়া যাক নতুন বছর, বহু কর্মের আকাঙ্ক্ষিত মুজিববর্ষের শুরুতে নারীর সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদনের বদলে মূলত শিরোনামগুলোই উল্লেখ করব, ঘটনা ও তর্ক-বিতর্কের পূর্বোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে।
জানুয়ারির প্রতিটি দিন দৃশ্যত নারী ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ বিভিন্ন দৈনিকে। আমরা এর আগে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করেছি মাত্র। সব পত্রিকা থেকে ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করতে গেলে বিশাল এক প্রবন্ধের আয়োজন করতে হবে। সে সুযোগ আমাদের নেই। তাই সাম্প্রতিক দু-চারটি ঘটনার উল্লেখে আমাদের দূষিত, পচনশীল সমাজের মৌল চরিত্রটি পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
লিখছি আর ভাবছি, কী হলো বাংলাদেশের সমাজটার যে ধর্ষণ বিনে তার কর্ম নেই। স্মরণযোগ্য যে এ বিষয়ে যে খবরগুলো দৈনিকপত্রে ছাপা হয়, তা দেশে সংঘটিত পুরো ধর্ষণ চালচিত্রের ভগ্নাংশ মাত্র। গ্রামাঞ্চলের সব ঘটনা পত্রিকা অবধি পৌঁছে না। এবং একালে গ্রামাঞ্চলেই নারী ধর্ষণ ও অবিচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি, পরিসংখ্যান তা-ই বলে।
১৭ জানুয়ারি একটি দৈনিক সংবাদপত্রের শিরোনাম: ‘বাস থেকে নামা কিশোরীকে ধর্ষণ’। খবরে প্রকাশ, ভৈরবে বাস থেকে নেমে এক কিশোরী সুনামগঞ্জের বাস খোঁজ করতে গিয়ে এক অটোরিকশাচালক ও তার সহযোগীদের গণধর্ষণের শিকার। মাত্র ১৩ বছর বয়সী ওই কিশোরী।
অপরাধ জগতের তথ্যবিবরণ রাখা পুলিশ তথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষক বাহিনীর ভালোভাবেই জানা অপরাধের নানাবিধ উৎস। যেমন—অটোরিকশা, কোনো কোনো ট্যাক্সি সংগঠন, বাস ড্রাইভার ও হেলপার থেকে শুরু করে বাসস্টেশন, রেলস্টেশনে ভ্রাম্যমাণ দুর্বৃত্ত দল। তাদের ওপর যাত্রীবান্ধব নজরদারি কঠোরভাবে পরিচালনা করলে অনেক একক মেয়ে যাত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। সে দায়িত্ব কি পালন করে থাকে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী।
একই প্রতিবেদনে আরো খবর : ‘মানিকগঞ্জের সিংগাইরে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে স্বামীকে বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ’। এ ছাড়া রয়েছে একই সূত্রে আরো কয়েকটি ধর্ষণের খবর। যেমন—রংপুরে ঘরে ঢুকে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ, গাজীপুরে এক স্কুলছাত্রীকে নেশার বস্তু প্রয়োগ করে ধর্ষণ, বরিশালের উজিরপুরে এক কিশোরীকে ধর্ষণ এবং বিচার চাওয়ায় ওই কিশোরীর নানাকে মারধর। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ধর্ষক স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য।
শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে, সিলেটে এক তরুণীকে তিন মাস আটকে রেখে ধর্ষণ করে এক সন্তানের জনক এক বিবাহিত যুবক। অবশ্য এ ঘটনার পেছনে অন্য ঘটনার সূত্রও রয়েছে (১৭.১.২০২০)। রূপগঞ্জে বস্ত্র কারখানার এক নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করে সুপারভাইজার জিন্নাহ আলী এবং তা ওই কারখানার ভেতরেই। পুলিশ অবশ্য জিন্নাহকে গ্রেপ্তার করেছে। মাত্র এক দিনের দুটো পত্রিকায় এতগুলো ধর্ষণ সংবাদ!
পরের ঘটনাটি আরো চমৎকার। ‘রাজশাহীর মোহনপুরে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার দায়ে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ’ (১৮.১.২০২০)। একই প্রতিবেদনে আরো খবর, কেরানীগঞ্জে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নড়াইলের লোহাগড়ায় ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক নারীকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। ‘কোটচাঁদপুরের পৌর মেয়র এবং সেখানকার নার্সিং হোম পরিচালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা।’
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দিন শেষের ধর্ষণ-হিসাব শেষে একই দিনের দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম : ‘বেড়েছে ধর্ষণের সঙ্গে পাশবিকতা’। সম্প্রতি ডেমরায় দুই কন্যাশিশু ধর্ষণ ও সুবর্ণচরের ধর্ষণ ঘটনার সূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদকের মন্তব্য : ‘দুধের শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ একাধিক সন্তানের জননী কেউই রক্ষা পাচ্ছে না ধর্ষকদের বিকৃত লালসা থেকে।’
আমাদের প্রশ্ন : নারীশিশু ধর্ষণের এই বীভৎসাচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনে দ্রুত বিচার ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে সরকার? ‘ক্রসফায়ার’ কোনো সমাধান নয়। দরকার তাত্ক্ষণিক বিচার ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা সমাজে শুদ্ধি অভিযান, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র মাদক কারবার, দুর্নীতি ও অনাচারের মূলোচ্ছেদ। সর্বোপরি সমাজটিকে দূষণমুক্ত করতে হবে সব দিকে, সুবিচারের নিশ্চয়তাসহ। শুদ্ধ সমাজ বিহনে নারীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে না।
লেখক: কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুৃন >> ট্রাম্পের যুদ্ধোন্মাদনা বন্ধ হোক