ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদের কারণে গরিব মুসলিমদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে- এমন অভিযোগ করা হয়েছে ভারতের একদল শিক্ষার্থীর করা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
গত সপ্তাহে ভারতের ৩০টি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উত্তরপ্রদেশের ১৫টি শহর ও জনপদ ঘুরে এই যৌথ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খবর বিবিসির।
নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশে অন্তত ২৩ জন নিহত হয়েছেন।
বুধবার দিল্লিতে ওই রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘পুলিশের গুলিচালনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা করা হয়েছে প্রান্তিক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এবং অনেক ক্ষেত্রে নাবালকদেরও। এখনও সেখানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে, মানুষ ভয়ে আছেন।’
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতে যে তীব্র প্রতিবাদ চলছে, তা সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী চেহারা নিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গত ১৯ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন।
তার পরদিন থেকেই তার রাজ্যের পুলিশ বেছে বেছে মুসলিমদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে বলে শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন।
মীরাট-মুজফফরপুর-আলিগড়ে যে দলটি গিয়েছিল, তাতে ছিলেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী থৃতি দাস। থৃতি বলেন, ‘আমরা চারটে দলে ভাগ হয়ে মোট পনেরোটা জায়গায় ঘুরেছি, আর সবাই এই হামলাগুলোর মধ্যে একটা কমন প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছি। প্রায় প্রতিটা হামলাই হয়েছে ২০শে ডিসেম্বর, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর হুঙ্কারের ঠিক পরদিন – আর সবগুলো হয়েছে বেলা তিনটা থেকে চারটার মধ্যে।’
তিনি জানান, ‘সেসময় মানুষ সদ্য দুপুরের নামাজ সেরে মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন। তারা কেউ কেউ হয়তো সংগঠিত কোনো পদযাত্রায় সামিল হচ্ছিলেন, অথবা শান্তিপূর্ণ মিছিল করে এগোচ্ছিলেন। তখনই পুলিশ তাদের বাধা দিয়ে চুপচাপ বসতে বলে। এরপরই শুরু হয়ে যায় বিনা প্ররোচনায় লাঠিচার্জ।’
থৃতি জানান, ‘যদিও পুলিশ দাবি করেছে তারা ফায়ারিং করেনি, আমাদের হাতে আসা ভিডিওতে তাদের গুলি চালাতেও দেখা গেছে। আমি তো বলব উত্তরপ্রদেশের পুলিশ নির্দিষ্টভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিশানা করে গুলি চালিয়েছে! যেখানে ভিক্টিমরা সবাই গরিব মহল্লার বাসিন্দা, বস্তিবাসী এবং দিন-এনে-দিন-খাওয়া মানুষজন!’
বিজনৌর-কানপুরে গিয়েছিলেন আর একটি দলের সদস্য আকাশ মিশ্রা, যিনি দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশনের ছাত্র।
আকাশ বলেন, ‘পুলিশ যেখানেই গুলি চালিয়েছে কোথাও কোমরের নিচে চালায়নি- সব জায়গায় নিশানা করেছে সোজা পেটে, মাথায় বা বুকে। সব জায়গাতেই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় বিজেপি বা আরএসএস পরিবারের লোকজন।’
তিনি জানান, ‘আর তারা এমনভাবে মুসলিমদের ভয় দেখিয়েছে যে গুলিতে আহতরাও কেউ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতে চাইছেন না- যদি আবার তাদের লাখ-দু’লাখ টাকার জরিমানার নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হয়!’
বহুক্ষেত্রে নিহতের পরিবারকে আজও পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেয়নি। অনেক জায়গাতেই মরদেহ পুলিশের দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে দাফন করে দিতে হয়েছে। আর নির্যাতন এখনও অব্যাহত রয়েছে। মুসলিম মহল্লায় পুলিশ যখন তখন হানা দিচ্ছে।
অনুসন্ধানী দলের সদস্য, দিল্লির ছাত্রী অনন্যা ভরদ্বাজ বলেন, ‘মানুষ এতটাই ভয় পেয়েছে যে আহতদের পরিবার আমাদেরও দরজা খুলে দিতে চাইছিল না। অনেকেই তারা ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। পুলিশ এখনও মুসলিমদের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে ছাদ টপকে, দরজায় বাড়ি মেরে- এমন কী মধ্যরাতের পরেও। মানুষকে তারা ঘুমোতে পর্যন্ত দিচ্ছে না।’
- বাংলাদেশি সন্দেহে ২০০ মুসলিমের ঘর গুঁড়িয়ে দিল ভারতীয় পুলিশ
- পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখলো বাংলাদেশ দল
প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতের সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট পামেলা ফিলিপোস। তিনি বলেন, ‘দেশের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো যখন এবিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব, তখন এই ছাত্রছাত্রীরাই জাতির বিবেকের কাজটি করল। তারা দেখিয়ে দিল, উত্তরপ্রদেশ কীভাবে ভারতের কিলিং ফিল্ডস বা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে- যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা করা হচ্ছে দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে, যাদের প্রতিবাদ করার কোনো শক্তিই নেই!’