শেষরাতে সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘুম ভাঙে বস্তিবাসীর। ঘুম ভাঙতেই সবাই দেখতে পান চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। ঝুঁপড়ি ঘরে থেকেও সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করে স্বপ্নের যে জাল বুনেছিলেন অনেকে চোখের সামনে পুড়তে দেখেন তাদের সেই স্বপ্ন। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও তার আগেই ভেঙে যায় শত মানুষের স্বপ্ন। আগুন কেড়ে নিয়ে যায় রাজধানীর মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির হাজারও অধিবাসীর সর্বস্ব।
সর্বশান্ত মানুষগুলোর বিলাপ-আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার বাতাস। সব হারানো মানুষগুলো যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
আজ শুক্রবার ভোর সোয়া চারটার দিকে মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে লাগা আগুনে নিঃস্ব হয়ে যায় শতাধিক পরিবার। দুই ঘণ্টার আগুনে বস্তির এসব ঘর পুড়ে যায়।
সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় চারিদিকে পড়ে আছে পোড়া টিন-আসবাবপত্র। বস্তিতে পোড়া ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কেউ কেউ পুড়ে যাওয়া জিনিস হাতড়ে মূল্যবান জিনিসপত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। অনেকে মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করছেন।
রাতের আগুন লাগার বর্ণনা দিতে গেয়ে কেঁদে ফেলেন বস্তিটির বেশ কয়েকজন বাসিন্দা। তারা জানান, ঘুমের মধ্যে আগুনের তাপ গায়ে লাগল। ঘুম ঘুম চোখেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর পুড়ে ছাই। তখন আর ঘরের মালামাল বা দামি জিনিসপত্র রক্ষার দিকে নজর নেই। কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসার চেষ্টা করি। পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে বাইরে নিয়ে আসা গেলেও ছাই হয়ে গেছে মাথা গোজার ঠাঁইটুকু। চোখের সামনে ছাই হয়ে গেছে কয়েক বছর ধরে অতি যত্নে সাজানো সংসার। এক মাসও হয়নি শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়েছে। সে বইয়ের সবগুলো পাতা উল্টে দেখার আগেই ব্যাগ ভর্তি বই, পড়ার টেবিলে সাজানো বই-খাতা সবই কেড়ে নিয়েছে আগুন।
ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্য মতে, রাত ৪টা ১২ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ৫টা ৪৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এই দেড় ঘণ্টায় মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন শতাধিক পরিবার।
শুক্রবার সকালে চলন্তিকা মোড় ঘর হারানো মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। কারণ এই ঘর কেবল তাদের মাথাগোঁজার ঠাই ছিল না, এই ঘর ছিল তাদের সংসার, লাখো স্মৃতি, স্বপ্ন।
চলন্তিকা বস্তিটি ঝিলের উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি। বিশাল জায়গা জুড়ে এখানে গড়ে উঠেছে তিনটি আলাদা বস্তি। যার নিয়ন্ত্রক স্থানীয় তিনজন প্রভাবশালী। গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগও রয়েছে এই বস্তিতে। নেয়া হয় বিল। কিন্তু সংযোগ বৈধ কিনা, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
এখানে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই ভাড়াটিয়া। অল্প টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে বস্তিটিতে বসবাস করেন নিম্ন আয়ের মানুষ। আবার নিজেদের সকল সহায়-সম্বল বিক্রি করে তা দিয়ে এই বস্তিতে ঘর তুলেছেন কেউ কেউ। মূলত তারাই এই ঘরগুলো ভাড়া দেন। গত রাতের আগুনে ঘরগুলো পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাই হয়ে গেছে তাদের স্বপ্নগুলোও।
- বিজেপি-মোদিতে বিপন্ন ভারতের গণতন্ত্র : ইকোনমিস্ট
- শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে নতুন কমিটির শ্রদ্ধা
পাঁচ মাস আগেও আগুনের ভয়াবহতা দেখেছিল এই বস্তির মানুষ। আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কিছু জানা যায়। আগুন লাগার কারণ তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত বছরের ১৬ আগস্ট ভয়াবহ আগুনের শিকার হয়েছিল এই বস্তিটি। সে সময় আড়াই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়। এসব ঘরে বসবাসকারীদের সেদিনের আর্তনাতে সপ্তাহব্যাপী শোকের ছায়া ছিল চলন্তিকা মোড় এলাকায়। ছাই হয়ে গিয়েছিল ঘর, সম্পদ।