আল-কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ইরাকে আইএসের পাশাপাশি নতুন প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে মার্কিন বাহিনীর। তাদের ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে রকেট হামলা বাড়ছে। এ অবস্থায় ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ভবিষ্যৎ কী, তা-ই উঠে এসেছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে।
বাগদাদের অতি সুরক্ষিত গ্রিন জোনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর ঘাঁটিতে লাউডস্পিকার দিয়ে রকেট হামলা দিয়ে সতর্কসংকেত বেজে উঠতে শোনা যাচ্ছে, ‘আসছে, আসছে।’
রাজধানীর অতিসুরক্ষিত গ্রিন জোনে এই মার্কিন ঘাঁটি। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের প্রাসাদ ছিল এখানেই।
প্রথমে যখন সতর্কসংকেত আসে, তার কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই বড় বড় দুটি বিস্ফোরণ শোনা গেল। এর পর আরেকটি ঘোষণায় ঘাঁটির সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে।
সোভিয়েত আমলের কাতিউশা রকেটের লক্ষ্যবস্তু সম্ভবত একটু দূরের মার্কিন দূতাবাসটি। ঘণ্টাখানেক পর জানানো হলো– সবাই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন।
মোট তিনটি রকেটের একটি গিয়ে পড়েছে টুইগ্রিস নদীতে। আর দুটি দূতাবাস চত্বরে। ৪২ বছর বয়সী এক বেসামরিক লোক বলেন, এটিই প্রথম কোনো এমন ঘটনা নয়, অবশ্য শেষ ঘটনাও নয়।
গত বছরের অক্টোবরে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ১০৯টি রকেট ছোড়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বলছে, ইরান সমর্থিত আধাসামরিক গোষ্ঠীগুলো এ হামলা করছে।
গত ৩ জানুয়ারি বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হলেন ইরানি প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। এর দিন পাচেক পর ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে উপর্যুপরি রকেট হামলা চালায় ইরান।
এতে ইরাকে যেসব ঘাঁটিতে মার্কিন সেনা রয়েছে, সেখানে নতুন করে নিরাপত্তা নিয়ম তৈরিতে বাধ্য হয়েছে। ঘাঁটির বাইরে সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে হলে প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ইরাকি অংশীদারদের ঘাঁটিতে যে করিডর দিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় জোট বাহিনীর কর্মকর্তাদের, সেখানে অন্যান্য ইরাকি কমান্ডারদের পাশাপাশি এখনও সোলাইমানির সঙ্গে নিহত মুহান্দিসের ছবিও ঝোলানো আছে।
কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা অনুভব করছেন, সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর সেখানকার পরিস্থিতি আরও জটিল ও গভীর হয়ে উঠছে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে– নিহত হওয়ার কয়েক দিন আগেও বাগদাদের গ্রিন জোটে ছিলেন ইরাকি একটি আধাসামরিক বাহিনীর কমান্ডার মুহান্দিস।
তার শিয়াপন্থী বাহিনী ইরানের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে আসছে, কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই ঘাঁটিতে তিনি ইরাকি সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। যারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার।
এই ড্রোন হামলার কয়েক দিন আগে মার্কিন ঘাঁটিতে রকেট হামলার জবাব দেয়ার জন্য ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের উভয় পাশে কাতায়েব হিজবুল্লাহর ওপর বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী, যাতে ওই শিয়া আধাসামরিক বাহিনীর ২৫ সদস্য নিহত হন।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের টিম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় এবং মিশন শেষ করতে চায়। আমরা ইরাকি জনগণকে বিশ্বাস করি এবং ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকেও বিশ্বাস করি।
ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মনে করে তারা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংকটের ফাঁদে পড়ে গেছে।
ইরাকি জয়েন্ট অপারেশন কমান্ডের মুখপাত্র মেজর জেনারেল তাহসিন আল-খাফাজি বলছেন, এটি আমাদের সমস্যা নয়। এমনকি এটি সামরিক কোনো সমস্যাও নয়। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা আছে, আর তারা আমাদের মাঝখানে ফেলে দিয়েছে।
ইরাকি সামরিক বাহিনী বলছে, সোলাইমানি হত্যার পর জোট সহায়তা না পাওয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে তাদের একাই লড়াই করা ছাড়া বিকল্প নেই। আইএসের বিরুদ্ধ বিমান হামলা চালাতে প্রথমবারের মতো আমরা আমাদের এফ-১৬ ফাইটার জেটগুলোকে উড়িয়েছি।
জেনারেল খাফাজি বলেন, এটি ঠিক যে, আমরা একা লড়াই করতে পারব, কিন্তু আমরা এখনও জোট বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করতে চাই, যদি রাজনৈতিক কোনো সমস্যা না থাকে।
এ মুহূর্তে সবকিছুই একটি ভারসাম্যের ওপর দুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী এতদিন যে হুমকি মোকাবেলা করত, তা আইএসে থেকে সরে একেবারে ভিন্ন কিছু হয়ে গেছে।
মার্কিন এয়ারম্যান আলেজানড্রো পেনার বক্তব্যে সেই কথাই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, যখন আমাদের এখানে মোতায়েন করা হয়, আমি ভেবেছিলাম আমি আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছি। কিন্তু কয়েক মাস পর এখানে দেখতে পাচ্ছি, আরে না, এখানে অন্য প্রতিপক্ষও রয়েছে।