দশম সংসদের তুলনায় প্রথম বছরে কম কার্যদিবস

ডেস্ক রিপোর্ট

সংসদ
ফাইল ছবি

নানা নাটকীয়তার নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একাদশ জাতীয় সংসদের আজ (৩০ জানুয়ারি) এক বছর পূর্তি। নির্বাচনী নাটকীয়তার মতোই কেটেছে এ সংসদের প্রথম বছর। বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত এমপিদের প্রথমে শপথানুষ্ঠান বর্জন এবং পরে শপথগ্রহণ যেমন আলোচনায় ছিল, তেমনি আলোচনায় ছিল এ সংসদে অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতায় প্রধানমন্ত্রীর বাজেট পেশও।

এছাড়াও আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে এমপিদের বক্তব্য নিয়েও। তবে সংসদ অধিবেশনে এমপিদের অনাগ্রহ, কোরাম সংকটের কারণে দেরিতে অধিবেশন শুরু হওয়া এবং সংসদীয় কমিটির বৈঠকের ছন্দপতন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে ফেলেছে সংশ্লিষ্টদের।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি যাত্রা করে একাদশ জাতীয় সংসদ। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এ সংসদের কার্যদিবস গেছে ৭৫টি। অথচ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম জাতীয় সংসদের প্রথম বছর কার্যদিবস ছিল ৮৫টি।

সংসদ সূত্র জানায়, গত এক বছরে সংসদের পাঁচটি অধিবেশন শেষ হয়েছে। চলছে ষষ্ঠ অধিবেশন। প্রথম অধিবেশনের কার্যদিবস ছিল ২৬ দিন। দ্বিতীয় অধিবেশনের কার্যদিবস পাঁচ দিন, তৃতীয় অধিবেশনে ২১ দিন, চতুর্থ অধিবেশনে চার দিন এবং সবশেষ পঞ্চম অধিবেশনের কার্যদিবস ছিল মাত্র পাঁচদিন। আর চলতি ষষ্ঠ অধিবেশনে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কেটেছে ১৫ কার্যদিবস। কোরাম সংকটে কারণে অধিবেশন দেরিতে শুরু হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটেছে। মোট ৭৫ কার্যদিবসে বিল পাস হয়েছে ২২টি।

নামে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি, সংসদ সরব রাখছে বিএনপি

দ্বিতীয়বারের মতো সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের যোগ্যতা অর্জন করলেও তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এমপিরা সরকারপ্রধান ও সরকারের প্রশংসায় ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের মতোই বক্তব্য রাখছেন, যা বিভিন্ন পরিসরে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে।

অন্যদিকে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের দাবি করে প্রথমে শপথ না নিয়েও পরে সংসদে যাওয়া বিএনপির এমপিরাই যেন বিরোধীদলের ভূমিকা নিয়েছেন। প্রাণ ফিরিয়েছেন সংসদে। একাদশ সংসদের সব ক’টি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে রেকর্ডও গড়েছেন দলটির এমপিরা। স্বল্প সংখ্যক হয়েও বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ ও প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন তারা। সংসদে উত্থাপিত প্রায় প্রতিটি বিলেই সংশোধনী আনা, পয়েন্ট অব অর্ডারে বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিসহ নানা ইস্যুতে কথা বলে অধিবেশন সরব রাখছেন তারা। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে ওয়াকআউটও করেন বিএনপির এমপিরা।

সংসদীয় কমিটিতে মন নেই এমপিদের

সরকার বা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করার জন্য ৪৩টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি (সংসদবিষয়ক মিলিয়ে কমিটি আছে ৫০টি) থাকলেও সেগুলো সেই অর্থে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না বলে অভিযোগ পর্যবেক্ষকদের। তারা বলছেন, এসব কমিটির সদস্যরা নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন। যেতে চান ঘন ঘন বিদেশ সফরে। অথচ সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী মাসে কমপক্ষে একটি করে বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানেনি বেশিরভাগ কমিটি। সে হিসাবে ৪৩টি কমিটি এক বছরে ৫১৬টি বৈঠক করার কথা থাকলেও হয়েছে তিন ভাগের দুই ভাগ, অর্থাৎ তিন শ’র মতো।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, নৌ-পবিহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ১২টির বেশি বৈঠক করেছে। আর কোনো কমিটিই ১২টি বা এর বেশি বৈঠক করতে পারেনি। গত দশম সংসদের মতো এবারও বেশি বৈঠক করে এগিয়ে আছে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এই কমিটি এরই মধ্যে ২২টি বৈঠক করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কমিটি মাত্র ৩টি বৈঠক করেছে।

নৌ-পরিবহন ১৬টি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ ১২টি, পররাষ্ট্র ১০টি, সরকারি প্রতিশ্রুতি ১০টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১০টি, মহিলা ও শিশু ১০টি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ১০টি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত ৯টি, স্বরাষ্ট্র ৯টি, আইন ৯টি, বেসামরিক বিমান ৯টি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ৯টি, পানিসম্পদ ৯টি, কৃষি ৯টি, শিক্ষা ৮টি, প্রবাসীকল্যাণ ৮টি, বাণিজ্য ৮টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ৮টি, সংস্কৃতি ৮টি, রেলপথ ৮টি, সমাজকল্যাণ ৭টি, বস্ত্র ও পাট ৭টি, শ্রম ও কর্মসংস্থান ৭টি, প্রতিরক্ষা ৭টি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ৭টি, শিল্প ৬টি, যুব ও ক্রীড়া ৬টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৬টি, জনপ্রশাসন ৫টি, পার্বত্য ৫টি, পরিকল্পনা ৫টি, ধর্ম ৫টি, ডাক ও টেলি যোগাযোগ ৫টি, তথ্য ৫টি, ভূমি ৫টি, খাদ্য ৪টি, সড়ক পরিবহন ও সেতু ৪টি, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় ৪টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ৪টি, এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ৪টি বৈঠক করেছে।

বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করায় আছে সমালোচনা

সংসদে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি আলোচনা হয় মাদক ব্যবসায়ী ও ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারেও। কিন্তু সরকারি ও বিরোধীদলের অনেক এমপি বিভিন্ন সময় মাদক ব্যবসায়ী ও ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি তোলেন। সবশেষ ১৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় এমপিরা একজোট হয়ে বলেন, এই পৃথিবীতে তাদের (ধর্ষকদের) থাকার কোনো অধিকার নেই। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, তাদের ক্রসফায়ারে দিলে কোনো পাপ হবে না। বরং বেহেশতে যাওয়া যাবে। ক্রসফায়ার দেয়ার নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে সংসদে এভাবে আলোচনা হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় এ ধরনের বক্তব্য সংবিধান-স্বীকৃত আইনের শাসন, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সব বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করারও আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

এছাড়া এ সংসদের প্রথম বাজেটের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ হয়ে পড়লে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থাপন করে বিরল নজির গড়েন।

সংসদে ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অ্যাডভোকেট রুমিন ফারহানা গণমাধ্যমকে বলেন, বিরোধী দল হিসেবে সংসদে কথা বলাটা আমাদের অধিকার। কিন্তু আমরা সংসদে সেই সুযোগ পাচ্ছি না। আমরা সংসদে ৭১ ধারায় বক্তব্য রাখতে পারি। আমি হয়তো ৮০ থেকে ৯০টি প্রশ্ন জমা দিয়েছি, কিন্তু প্রশ্ন (আলোচনায়) এসেছে দুই-তিনটা। বলা হয় লটারিতে প্রশ্ন দেয়া হয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড বারবার দেখা যায়, একই ব্যক্তি বারবার এক-দুই নম্বর প্রশ্ন করতে থাকেন। লটারিতেই যদি হয়, তাহলে এক-দুইজন ব্যক্তিই বারবার প্রথম প্রশ্ন করার সুযোগ পান কীভাবে? পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলার জন্য হাত তুললে দেয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীকে সম্পূরক প্রশ্ন করব কিন্তু তা দেয়া হয় না। তাই আমি বলব আমাদের দিকে মনে হয় আরেকটু বেশি সময় দেয়া উচিত। আমি কথা বললেই সংসদে হৈ চৈ করেন সরকারি দলের এমপিরা। তবে আগের তুলনায় এখন কম করেন। আর আমরা সংসদকে অবৈধ বললেই তা সাথে সাথে এক্সপাঞ্জ করা হয়। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অশ্রাব্য, অশ্লীল ভাষায় সংসদে বক্তব্য রাখলেও তা এক্সপাঞ্জ করা হয় না। আওয়ামী লীগের নারী এমপি সংসদে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন আর পুরুষরা সেটার বন্দনা করেন। এর চেয়ে আর তো বেশি কিছু দেখি না।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে