চীনের উহান প্রদেশ থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের জন্য এক ধরনের সাপই প্রধান উৎস হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাসের জন্য চূড়ান্তভাবে বাঁদুড়ই দায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
পরিবেশগত স্বাস্থ্যখাতের অলাভজনক সংস্থা ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট ডা. পিটার ড্যাসজাক বলেছেন, ভাইরাসটির জেনেটিক ক্রমের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রত্যেক করোনাভাইরাসের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। আর এই ভাইরাসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ভাইরাসটিও বাদুড় থেকে ছড়ায়।
বুধবার ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় চীনা রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের অধ্যাপক গুইঝেন উ বলেছেন, তারা এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটির সঙ্গে বাঁদুড়ের শরীরে পাওয়া ভাইরাসের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রাণী জগতে বাদুড়কে দীর্ঘ সময় ধরেই বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ছড়ানোর দায়ে ভিলেন হিসেবে দেখা হয়।
ডানাযুক্ত স্তন্যপায়ী এই প্রাণীটি মার্বার্গ, নিপাহ ও হেন্দ্রাহ-সহ আরও বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের আধার। যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং উগান্ডায় ইতোমধ্যে মানুষের শরীরে রোগ এবং প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে।
বাদুড়কে প্রাকৃতিকভাবেই ইবোলা, র্যাবিস, সার্স এবং মার্স ভাইরাসের বাহক বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে সার্স এবং মার্স করোনাভাইরাস দুটি বর্তমানে একই রুপে উহানে আবির্ভূত হয়েছে। ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের বিস্তারের সময় বেড়ালের মতো এক ধরনের প্রাণীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। আর এই প্রাণীর দেহে ভাইরাসটি বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এশিয়ার বেশ কিছু দেশে বেড়ালের মতো দেখতে ওই প্রাণীটির মাংস খাওয়া হয়। এছাড়া ২০০০ সালের দিকে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া মার্স ভাইরাসের উৎপত্তিও ছিল উট।
বিজ্ঞানীরা এই ধরনের ভাইরাসকে সংক্রামক হিসেবে বলে থাকেন; যা প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে স্থানান্তর হয়। নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের মারাত্মক প্রদাহ-সহ (এনসেফালাইটিস) বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়; যা বাদুড়ের মূত্র অথবা লালার মাধ্যমে খেজুরের রসে সংক্রমিত হয়। সংক্রমিত এই খেজুরের রস পানে মানুষের শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে যায়।
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের ভাইরাসবিদ ডা. স্ট্যাথিস জিওটিস বলেন, বাদুড়বাহিত ভাইরাস নিয়ে কর্মরত ভাইরাসবিদদের কাছে নতুন এই করোনাভাইরাসের সঙ্গে বাদুড়ের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আশ্বর্যজনক হিসেবে আসেনি। তিনি বলেন, সংক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে ভাইরাসের জন্ম এবং পুনর্জন্ম দেয়ার জন্য বাদুড়কে গুরুত্বপূর্ণ আধার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিজ্ঞানী জিওটিস বলেন, চীনের বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে হর্স সো প্রজাতির বাদুড় থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভাইরাস লালন এবং ছড়ানোর জন্য বাদুড় কেন দায়ী
পৃথিবীতে অন্তত ১ হাজার ৩০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। ভৌগলিক কারণে স্তন্যপায়ী এই প্রাণীটি বৈচিত্র্যময়; শুধুমাত্র এন্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই এর বসবাস রয়েছে। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বাদুড় দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী। একটি গুহার মধ্যে একসঙ্গে কয়েক লাখ বাদুড় বসবাস করতে পারে। যে কারণে তাদের শরীরে বাসা বেধে থাকা বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাস সহজেই পরস্পরের সংস্পর্শে আসে।
উচু স্তরের বেশ কয়েকটি ভাইরাস বাদুড় নিজের শরীরে বহন করে বলে ধারণা করা হয়। জিওটিস বলেন, বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমানে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, অত্যধিক উড়ার সক্ষমতার কারণে বাদুড়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বদলে গেছে। এই অনুমানের সমর্থনে বিজ্ঞানীরা বাদুড়ের জেনেটিক গঠনে বেশ কিছু পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন।
তবে কী উহানের এই ভাইরাস বাদুড় থেকে ছড়িয়েছে?
চীনের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বাদুরবাহিত ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। এর আগে তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, বাদুড়বাহিত প্রাণঘাতী ভাইরাস বিস্তার ও পরবর্তী মহামারীর প্রাণকেন্দ্র হতে পারে চীন। গত বছর উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় একটি প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
এতে তারা বলেন, সাধারণত এটি বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, বাদুড়বাহিত করোনাভাইরাসগুলো পুনরায় পরবর্তী রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হবে। এক্ষেত্রে চীন এই প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কখন এবং কোথায় এ ধরনের প্রাদুর্ভাব শুরু হবে সেব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা চ্যালেঞ্জের।
ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট ডা. পিটার ড্যাসজাক বলেন, চীনে বিজ্ঞানীরা সার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্তত ৫০টি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দেশটির বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে পেয়েছেন। ২০০৩ সালে দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে সার্স করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল। শুরুতে যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই গুহার পাশে বসবাস করছিলেন। পরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা চালিয়ে গুহার বাদুড়ের শরীরে সার্স করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পান।
তিনি বলেন, মহামারী বিস্তারের জন্য এসব ভাইরাস আসলেই উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে। বৃহৎ পরিবারের এসব ভাইরাস আস্তানা গেড়েছে বাদুড়ের শরীরে; যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত বাদুড়ের সংস্পর্শে আসছেন এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, তবে উহানের করোনাভাইরাস বাদুড় নাকি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অন্য কোনও প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে; তা নিশ্চিত করে এই মুহূর্তে বলাটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
দেশটির একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা এই নভেল করোনাভাইরাসের উৎস খুঁজে বের করার জন্য ল্যাব এবং মাঠে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরিচালক উ বলেন, প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাসটি এক বাদুড়ের শরীর থেকে অন্য বাদুড়ের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। পরে সেখান থেকে বন্য অজ্ঞাত কোনও প্রাণী হয়ে মানুষের শরীরে বিস্তার ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরে যখন উহানে এই ভাইরাসটির বিস্তার ঘটে তখন ওই সামুদ্রিক খাবারের বাজারে কোনও বাদুড় বিক্রি কিংবা পাওয়া যায়নি।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙলিয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক সায়েন্স মিডিয়া সেন্টারকে বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে এই করোনাভাইরাসটি ইতোমধ্যে বাদুড় এবং সাপের শরীরে পাওয়া গেছে। সাপ এবং বাদুড়ের স্ট্রেনের সঙ্গে মানুষের স্ট্রেনের মিল রয়েছে।
- আরও পড়ুন >> ‘সুষ্ঠু ভোটের জন্য কেন্দ্র পাহারা দেবে আ.লীগ’
বৃহস্পতিবার চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশটির সব অঞ্চলেই এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যাঞ্চলের উহানে প্রথম এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১৭০ জনের প্রাণহানি ও ৭ হাজার ৭১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
সূত্র : সিএনএন।