রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও তৎপরতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। হচ্ছে না মূলত মিয়ানমারের সামরিক-বেসামরিক শাসক শ্রেণির যুক্তিহীন জেদ ও একগুঁয়েমির কারণে। চরমপন্থীদের ভাষায়—এসব হচ্ছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক শয়তানি। বাংলাদেশের নমনীয় ভূমিকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা না রাখা, সোজা ভাষায় যার নাম প্রতারণা।
এ প্রতারণার কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এক ধরনের অসহায় অবস্থার জালে বন্দি। এ বিষয়ে আমরা একাধিকবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাতায়াতের পক্ষে পরামর্শ রেখেছি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কিছুটা তৎপর হলেও তাদের নিরাপত্তা পরিষদের এ ব্যাপারে কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই। কারণ প্রধানত চীনের সম্ভাব্য ভেটো।
শেষ পর্যন্ত বহু কথিত আন্তর্জাতিক হেগ আদালতেই যেতে হলো আলোচ্য গণহত্যার বিচার সম্পর্কে চাপ সৃষ্টির জন্য, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে। এ বিষয়ে সত্যি বলতে কি, আমি খুব একটা আশাবাদী নই। কারণ একটাই। আর তা হলো চীনের দ্বৈত ভূমিকা। একদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে চীনের আশ্বাস, যেমন ভারতও দিচ্ছে; অন্যদিকে মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ তৎপরতা, রাখাইনে সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ ঠিকই দ্রুতবেগে চালাচ্ছে।
এ প্রত্যাবাসনের চাবিকাঠি বাস্তবিকই চীনের হাতে। এ সত্যটি আমাদের লেখায় বহুবার উল্লেখ করেছি। চীন আন্তরিকভাবে চাইলে এ সমস্যার সমাধানও তাত্ক্ষণিকভাবেই হতে পারে। চীনের সম্মতি ছাড়া বিষয়টিকে নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে গেলে এর বিরুদ্ধে চীনের ভেটোর (আপত্তি) খুবই সম্ভাবনা। তাই চীনকে সপক্ষে টানার কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের।
দুই.
তবু হেগ আদালতে যাওয়া অপরিহার্যই ছিল বলতে হয়। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, তেমনটিই ঘটেছে। ওই আদালতের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষেই গেছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার পরোক্ষ স্বীকৃতি মিলেছে, সেই সঙ্গে তাদের সুরক্ষারও। এ সম্পর্কে আদালতের রায়ে চার দফা নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। সেগুলো মানার দায় মিয়ানমারের।
দফাগুলো হচ্ছে : ‘জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের হত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে মিয়ানমার সরকারকে। সেনাবাহিনী বা অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংঘটন, ষড়যন্ত্র বা উসকানি দিতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্য-প্রমাণ রক্ষা করতে হবে। এবং চার মাসের মধ্যে আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা আদালতকে জানাতে হবে।’
আদেশ বা নির্দেশ সব কয়টাই গুরুত্বপূর্ণ। এ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা এর আগে ছোট আফ্রিকান রাষ্ট্র গাম্বিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। এবার ধন্যবাদ হেগের আন্তর্জাতিক আদালতকে। এ রায় বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। কারণ বিচারে জয়টা আন্তর্জাতিক চরিত্রের।
সু চির বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) সর্বসম্মতিক্রমে এই অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছে এ কারণে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার ফাঁকে রোহিঙ্গাদের আবার গণহত্যার সম্মুখীন হতে না হয়। এটা বিচারকদের তরফ থেকে সদিচ্ছার প্রকাশ। এতে এটাও ধরে নেওয়া যায় যে তাঁরা রোহিঙ্গা গণহত্যা সম্পর্কে কোনো সংশয় পোষণ করেন না।
যেহেতু রায়টি পূর্ণাঙ্গ বিচার-বিশ্লেষণ উত্তর পর্যায়ের নয়, তাই এখানে এতে রোহিঙ্গা শারণার্থী প্রত্যাবাসন সম্পর্কে কোনো নির্দেশ নেই, নেই গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত বা রায়। কাজেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সময়ের কাঁটায় ঝুলে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
আমরা আইসিজেকে ধন্যবাদ জানিয়েছি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক সীমাবদ্ধ প্রাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে। যে চার দফার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার সবটুকুই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিষয়ক; তাদের যে ১০ লক্ষাধিক সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী, তাদের ফেরত যাওয়া, তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়া ও নিরাপদ বসবাস সম্পর্কিত বিষয়ক নয়। এখানেই আইসিজের রায় বা নির্দেশের নেতিবাচকতা।
এর ইতিবাচক দিক হলো, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অং সান সু চির নির্বিচার মিথ্যাচার সত্ত্বেও আদালত সর্বসম্মতিক্রমে মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা গণহত্যার বর্বরতা সত্য বলে গ্রহণ করে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের দায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপিয়েছেন এবং তা পালন করার নিশ্চয়তা বিধানের পক্ষে আদালতকে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করার দায়িত্বও তাদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও দুর্বোধ্য কারণে একটি বিষয়ে তাঁরা পিছিয়ে থাকলেন কেন, তার কারণ খুব স্পষ্ট নয়। মিয়ানমার জাতিসংঘের রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ক তদন্ত কমিটিকে মিয়ানমারে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়নি, যে জন্য তাদের অকুস্থলের বাইরে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে, যাতে তাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং হবে। আদালত জাতিসংঘের পক্ষে এ নির্দেশটি দিতে পারতেন যে জাতিসংঘ তদন্ত কমিটিকে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করে তদন্ত চালানোর অনুমতি দেওয়া হোক। যাতে তারা সুস্পষ্টভাবে সঠিকভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত চালাতে পারে এবং সত্য বেরিয়ে আসতে পারে।
কিন্তু বিস্ময়কর যে আদালত জাতিসংঘেরই (আর কারো নয়) তদন্ত কমিটিকে মিয়ানমারে প্রবেশের জন্য সেখানকার সরকারের প্রতি কোনো নির্দেশ জারি করেননি। তাহলে সুবিচারের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ কিভাবে সংগৃহীত হবে? এটা বিচারকরা কেন ভেবে দেখেননি—এ সম্পর্কে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি রোহিঙ্গা গণহত্যা সম্পর্কে প্রকাশ্য অভিযোগ তাদের বক্তব্যে নেই। হতে পারে, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা আসতে পারে সম্পূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণের তথ্য পাওয়ার পর। কিন্তু সে পথ তো মিয়ানমার শুরু থেকেই বন্ধ করে রেখেছে জাতিসংঘ তদন্ত কমিটিকে অকুস্থলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এবার আদালতও একই পথ ধরলেন এ সম্পর্কে রায় না দিয়ে।
তিন.
এখন অন্তর্বর্তীকালন আদালত-নির্দেশ অনেকটা রোহিঙ্গাদের তথা বাংলাদেশের পক্ষে গেলেও এ মামলার বড় সমস্যা একাধিক। প্রথমত, একটি কথা সবাই উল্লেখ করেছেন যে মামলার চূড়ান্ত রায় পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূলত বাংলাদেশ। লাভবান হবে মিয়ানমার। তারা এরই মধ্যে রাখাইনে যা পরিবর্তন ঘটানোর তা ঘটিয়ে ফেলবে।
দ্বিতীয়ত, এরই মধ্যে সু চি এবং মিয়ানমার সরকার আইসিজের রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এ রায় পরিস্থিতির অবাস্তব তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছে বলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের তদন্ত মতে কিছু যুদ্ধাপরাধ ঘটে থাকলেও রোহিঙ্গা গণহত্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর যুদ্ধাপরাধের বিচার তারা নিজেরাই করবে। এমনকি রোহিঙ্গা-সুরক্ষা সম্পর্কে আদালত যা যা বলেছেন, সেসব তারা এরই মধ্যে করে ফেলেছে।
মিথ্যারও একটা সীমা থাকে। সু চি থেকে শুরু করে মিয়ানমারের চতুর শাসকরা সেসব সীমা অতিক্রম করে তাদের অবস্থান প্রথম থেকেই সুদৃঢ় করে রেখেছেন। এসবের পেছনে চীনের মদদ, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি আন্তর্জাতিক শক্তির নীরবতা কাজ করছে মিয়ানমারের পক্ষে, পরোক্ষভাবে। কজেই মিয়ানমারের পক্ষে অবলীলাক্রমে মিথ্যাচারে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে বড় প্রশ্ন : হেগের আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন রায় আপাতদৃষ্টিতে মিয়ানমারবিরোধী এবং রোহিঙ্গা-গাম্বিয়া-বাংলাদেশের পক্ষে হলেও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিবর্তনে এবং সমস্যার সমাধানে কতটা সহায়ক হবে? সময় যত যাবে, পরিস্থিতি ততটাই মিয়ানমারের স্বার্থের অনুসারী হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী সমস্যা দেশটির জন্য একের পর এক জটিলতা সৃষ্টি করে চলবে—যা হবে সামাজিক-রাজনৈতিক চরিত্রের।
সন্দেহ নেই, এ রায়ে মিয়ানমারের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মহলে মিয়ানমার শাসকদের ভাবমূর্তিতে কালো ছাপ পড়েছে। তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যসিদ্ধির ক্ষেত্রে সফলতার কড়ি এখনো তাদের হাতে। চূড়ান্ত রায়ে হারলেও তাদের লক্ষ্য অর্জন হাতের মুঠোয়।
তাই এ রায়ে বাংলাদেশের পরিতৃপ্তির অবকাশ নেই। বরং তাদের উচিত হবে এই অন্তর্বর্তী সময়ের সুযোগ কাজে লাগানো। আর সেটা হবে চীনসহ আন্তর্জাতিক পরাশক্তিকে কূটনৈতিক তৎপরতায় সপক্ষে টেনে আনা। বর্তমানে এ সমস্যার সমাধানে মূল শক্তি চীন ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশকে তাই নৈতিক জয়ের কড়ি হাতে নিয়ে নিজস্ব সম্পর্কের ভিত্তিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারতের পূর্ণ সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে অতীব বিচক্ষণতার পথ ধরে। অন্যথায় রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের কাঁধ থেকে নামবে না।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> ধর্ষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে