ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচন হয়ে গেছে। কিন্তু উত্তাপ কমেনি। একটি পুরনো চিত্র দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বলছে, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কেউ কেউ বলেছে, এ রকম শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কখনো হয়নি। অন্যদিকে বিএনপির কণ্ঠে সেই একই সুর। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা গুণ্ডামি করেছে। বিএনপির পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ২০০ থেকে আড়াই শ করে আওয়ামী লীগের সমর্থক হাজির থেকে জটলা পাকিয়ে ভোটদাতাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। এতে নির্বাচনে ভোটদাতাদের অংশগ্রহণও কম।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপি গত রবিবার শহরে হরতাল ডেকেছিল। বহুকাল পর বিএনপি আবার হরতাল ডাকল। এতে সমর্থন জানিয়েছেন, ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহসহ বিএনপি সমর্থক বেশ কিছু চেনা মুখ। ড. কামাল ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন। দোতলায় ভোটদান কক্ষে উঠতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। উপস্থিত লোকজন তাঁকে সাহায্য জুগিয়েছে। ভোট দিতে অন্যের লাগে পাঁচ কি ১০ মিনিট। তাঁর লেগেছে আধা ঘণ্টা।
এবারই প্রথম দেশে নির্বাচনে শতভাগ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহৃত হলো। ড. কামালের আঙুলের ছাপ মিলছিল না। ভোটকেন্দ্রের কর্মীরাই তাঁকে তা মেলাতে সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর কেন্দ্রে কোনো অব্যবস্থা ও অনিয়ম হতে দেখেননি। তবু বিএনপির হরতালের ডাকে সমর্থন দিয়েছেন। কথায় বলে, ‘সব শিয়ালের এক রা।’ বিএনপির হরতালের ডাকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের বেলায় এই প্রবাদ প্রযোজ্য।
আমার শঙ্কা ছিল, হরতাল সফল হবে না; কিন্তু বিএনপি ও ছাত্রদলের কর্মীরা আবার রাজপথে নেমে বোমাবাজি ও রক্তারক্তির কাণ্ড না ঘটায়। বিএনপি নেতাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। তাঁরা এবার সে পথে যাননি। হরতালে যে সাধারণ মানুষের অনীহা, সেটি এবার আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এ কথা সত্য, এবার ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটদাতাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শতকরা ২৫ ভাগ বা ৩০ ভাগ ভোটাদাতার বেশি ভোট দেয়নি। এর কারণ কী? বিএনপির অভিযোগ অনুযায়ী, ভোটদাতারা কি ভয় পেয়ে ভোট দিতে আসেনি? সত্যি সত্যি কি ভোটকেন্দ্রগুলোতে গুণ্ডামি হয়েছে? বিএনপির এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে?
আমি বিদেশে থাকি। তবু দেশের দিকেই নজর রাখি বেশি। এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দেশে যে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় বন্ধুরা আছেন, তাঁদের কাছ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। তাঁরা বলেছেন, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তবে একেবারে শান্তিপূর্ণ হয়নি। এর কারণ কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে কোনো কোনো কেন্দ্রে সংঘর্ষ। সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয় পক্ষই এবার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়তা দেখিয়েছে। তথাপি কোনো কোনো কেন্দ্রে বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তা তেমন ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
কোনো মহিলা বা পুরুষ ভোটদাতা ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিতে না জেনে ভোটকেন্দ্রের কোনো কর্মীর সাহায্য চেয়েছেন। তিনি তাঁর হয়ে নৌকা মার্কায় ছাপ দিয়েছেন—এমন হতে পারে এবং হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিএনপির পোলিং এজেন্টরা বহু কেন্দ্রে যাননি। তাঁরা নাকি ভয় পেয়েছিলেন। শিশুদের মতো কল্পিত ভূতের ভয়ে ঘর থেকে বের না হওয়ার মতো তাঁরা ভয় পেয়ে থাকলে বলার কিছু থাকে না। তবে এমনও হতে পারে, বিএনপি এবার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে তুলনাযোগ্য প্রার্থী দিতে না পারায় ধরেই নিয়েছিল যে তাদের পরাজয় অনিবার্য। এই পরাজয়ের গ্লানি এড়ানোর জন্যই ভোটকেন্দ্রে নিজেদের পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিত রেখে আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপাচ্ছে যে তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ওপর দোষ চাপানো গেছে এই বলে যে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়নি। সাক্ষী দেওয়ার জন্য তো নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই আমার স্নেহভাজন মাহবুব তালুকদার আছেন। তিনিও এবার স্বীকার করেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তবে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।
এ কথা সত্য, এবারের এই নির্বাচনে ভোটদাতাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নাগরিক দায়িত্ব পালনে নাগরিকরা যদি সচেতনতা না দেখায়, সেটি গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত—এ কথা সত্য। কিন্তু ঢাকার নাগরিকরা এবার তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালনে এতটা অনীহা দেখাল কেন?
এ সম্পর্কে কয়েকটি কারণ আমার মনে হয়েছে। এবারের নির্বাচনে এত কম ভোট পড়ার প্রথম কারণ, এবার ভোটপত্রে ছাপ্পা ভোট মারার সুযোগ হয়নি। সমুদ্রে ভাটা হলে নদ-নদীর জলস্ফীতি যেমন দ্রুত কমে যায়, তেমনি এবার জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় এবং ভোটস্ফীতি না ঘটায় আসল ভোট কম পড়েছে। দ্বিতীয় কারণ, ভোটের দিন গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। অক্ষম মানুষ, নারী ও বৃদ্ধ ছাড়াও সক্ষম নর-নারীদের অনেকেরই হেঁটে গিয়ে ভোট দেওয়ার আগ্রহ থাকে না।
তৃতীয় কারণ, বিএনপি নির্বাচনে হেরে গেলেও প্রচারণায় জিতেছে। তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রচারণা ছিল, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, ভোটের আগের রাতেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাপ্পা ভোটে ভোট বাক্স পূর্ণ করে রাখবে। এই প্রচারণা শুনে অনেক ভোটদাতাই হয়তো ভেবেছে, অযথা এতটা পথ হেঁটে গিয়ে ভোট দিয়ে লাভ কী? যাঁরা জেতার তাঁরা তো আগেই জিতে আছেন।
চতুর্থ কারণ, প্রকৃত ভোটদাতাদের মনে ভোটদানে অনীহা। এটি নির্বাচন কমিশন বা ক্ষমতাসীন সরকার বা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা নয়, এটি এক ধরনের অনীহা। যেসব দেশে দীর্ঘকাল ধরে সামরিক অথবা স্বৈরাচারী শাসন কায়েম থাকে, সেসব দেশের নাগরিকদের মনে নির্বাচনে ভোটদানে এক ধরনের অনীহা বা অনাগ্রহ জন্মে। তারা ভাবে, ভোট দিয়ে কী হবে? ভোট দিয়ে তো তারা সরকারের পরিবর্তন ঘটানো বা নিজেদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আনতে পারছে না।
এ ধরনের নির্বাচনভীতি বা ভোটদানে অনীহা রোগ লাতিন আমেরিকার ডিক্টেটর শাসিত কয়েকটি দেশে দেখা দিয়েছিল। তখন ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল তাদের দেশের মানুষের মনে নাগরিক চেতনা ও দায়িত্ববোধ ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনে নেমেছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো আন্দোলন কখনো হয়েছে কি? বরং বিএনপি ও তাদের সতীর্থ সুধীসমাজ অনবরত নেগেটিভ প্রচারণা চালিয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আওয়ামী লীগ ছাপ্পা মারা ভোটে আগেই তাদের প্রার্থীদের নির্বাচনে জিতিয়ে রাখবে। সুতরাং তাদের না-বলা কথা হচ্ছে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বা ভোট দিয়ে লাভ নেই।
এই নেগেটিভ প্রচারণা ব্যর্থ করে, দেশের মানুষের মনে নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ হ্রাস পেয়ে থাকলে, তা ফিরিয়ে আনার প্রধান দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের। শুধু নির্বাচন এলে ভোটদাতাদের কাছে ভোট চাইলেই হবে না; গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এই ভোট কেন দিতে হবে, সেই চেতনা, সেই দায়িত্ববোধও নাগরিকদের মনে জাগিয়ে রাখতে হবে।
এটি শুধু আওয়ামী লীগের একার দায়িত্ব নয়। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। বিএনপি ও তথাকথিত সুধীসমাজেরও দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন না করে নাগরিকদের ক্রমাগত ‘সুষ্ঠু ভোট হবে না, আওয়ামী লীগ ভোট চুরি করবে ইত্যাদি প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে নির্বাচনবিমুখ করা একটি বড় ধরনের অপরাধ। বলেছেন, লাতিন আমেরিকার একটি দেশের নেতা শাভেজ। আর গণতন্ত্রের কেতাবি পণ্ডিত ড. কামাল হোসেন ও তাঁর সতীর্থরা এ কথাটি জানেন না, এটি ভাবলে দুঃখ হয়।