ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ কাউন্সিলর নির্বাচন ধুমধাড়াক্কা প্রচারের মধ্য দিয়ে শেষ হলো। হলো আওয়ামী লীগের প্রত্যাশিত বিজয়ে। দুই মেয়রই আওয়ামী লীগের। যথারীতি নির্বাচন মুক্ত, অবাধ ও ত্রুটিহীন না হওয়ার অভিযোগে পরদিন বিএনপির ব্যর্থ হরতাল।
এ নির্বাচন নিয়ে সব রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিমনস্ক মানুষ ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রত্যাশা ছিল অনেক। প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের, যা নিয়ে অভিযোগের সুযোগ থাকবে না। নির্বাচনের একটি আদর্শ ধারা তৈরি হবে, যা আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি করবে। সন্দেহবাদীরা ভিন্ন ধারণা পোষণ করেছে। কিন্তু গণমাধ্যমে, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু কিছু ঘটনার আলামত ওই প্রত্যাশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। করেছে কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞের প্রকাশিত মতামত তাঁদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁদের বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। কারণ তাঁরা সবাই ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ করে কেউ কেউ ভোট কেমন হচ্ছে তা দেখার উদ্দেশ্যে সেখানে কিছু সময় কাটিয়েছেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন অন্য সবার মতোই বলেছেন যে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনা ছাড়া ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে। তবে তিনি লক্ষ করেছেন সরকারদলীয় প্রার্থীর ব্যাজপরা যুবকদের জটলা ভোটকেন্দ্রের বাইরে। তাতে ভোটারদের মনে ভয়ভীতির প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাঁর মতে এদের উপস্থিতিতে নির্বাচনী আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। এদের কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।
‘একটা পর্যায়ে এসে দেখলাম, নির্বাচনী আচরণবিধি ব্যাপক লঙ্ঘন হচ্ছে। তখন যদি নির্বাচন কমিশন কথা বলতে পারত, নিয়মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারত, তাহলে হয়তো পরবর্তী সময়ে এসব কাণ্ড হতো না’ ইত্যাদি বলে তিনি কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
একটি দৈনিকের প্রতিবেদনেও উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থনে তথ্য মেলে। তবে তাদের বক্তব্য ভোটকেন্দ্রের ভেতরের দৃশ্যপট নিয়েও। সেখানে প্রতিবেদকের মতে ‘কিছু কেন্দ্রের ভেতর সরকারি দলের কর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। বুথ বা ভোটকক্ষের চিত্র আরো খারাপ। সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। এর বাইরে নৌকার ব্যাজধারী তিন-চারজন করে অবস্থান করতে দেখা যায়।’
নির্বাচন কমিশন এ ধরনের অনিয়ম লক্ষ করেনি বা লক্ষ করলেও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করেনি। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু-একজন ভোটারের অভিযোগ, আঙুলে ছাপ দেওয়ার পর নিজে ভোট দিতে পারেননি। গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বাটন চাপ দিয়ে তাঁর ভোট দিয়ে দিয়েছেন।
এ ধরনের কিছু বিবরণ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্বভাবতই সমাজের দু-একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনের শুদ্ধতা ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আবার একই স্তরের অন্য কেউ কেউ নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য হয়েছে’ বলে মতামত প্রকাশ করেছেন।
দুই.
নির্বাচন নিয়ে দু-একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শেষ কথা বলা সম্ভব নয়। তবে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা জাতীয়পর্যায়ে রাজনীতির জন্য ভাবনার বিষয়। প্রথম বিষয়টি হলো নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার স্বল্পতা। প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মোটা হরফে প্রথম শিরোনাম করেছে।
যেমন ‘কম ভোটে নৌকার বড় জয়’। অন্য একটি দৈনিকে অনুরূপ গুরুত্বে শিরোনাম : ‘এত কম ভোট!’ অন্য একটিতে আরো বড় হরফে লেখা ‘স্বল্প ভোটারে নৌকার বড় জয়’। একই ধরনের আরেকটি শিরোনাম : ‘ভোটার উপস্থিতি খুবই কম।’ আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার তো লিখেছেন এমন শিরোনামে : ‘ভোটারদের উপস্থিতি খুবই নৈরাশ্যজনক।’
সত্যিই ঘটনাটি ভাবিয়ে তোলার মতো। এর তাৎপর্য ও পরিণাম দুই-ই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ বাংলাদেশের ভোটারদের খ্যাতি বা পরিচিতি আছে ‘ভোটপাগল’ হিসেবে। ভোটদান এদের মৌলিক অধিকার, বিশেষ ক্ষমতা বলে এরা মনে করে। তাই পরিস্থিতি যেমনই হোক, ভোটের ময়দানে হাজির হতে হবে। এমন এক মানসিকতা বা ভোটদান প্রবণতার মধ্যে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে সাড়ম্বর প্রচারণার পর অনুমিত ভোটার উপস্থিতির হার যদি হয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, তাহলে বিষয়টি ভাবনার বৈকি।
নির্বাচন কমিশন আপাতদৃষ্টিতে পরিতৃপ্ত। তাদের ধারণা, তারা একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছে জাতিকে। অথচ অবাক হওয়ার মতো ঘটনা, সিইসির মতে ভোটারদের উপস্থিতির হার মোট ভোটার সংখ্যার হিসাবে ৩০ শতাংশের মতো হবে। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম এবং ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত হিসাবে এই সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
ঘটনা বাস্তবিকই বিস্ময়কর; এর তাৎপর্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিশেষ করে তা রাজনৈতিক অঙ্গনের স্বার্থবিচারে। সাধারণ বিচারে এমন কথা বলা হচ্ছে—নির্বাচনে ভোটারদের আস্থার অভাব। এই আস্থার অভাবকে কি রাজনৈতিক হতাশা বলে আখ্যায়িত করা যাবে? অর্থাৎ ভোট দিয়েও যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাচ্ছে না—সমাজে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অনাচার একইভাবে চলবে, ভোগ্যপণ্যের দাম যখন যেমন খুশি বাড়তেই থাকবে, তাহলে কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন কী। নির্বাচন আপন ধারামতেই চলতে থাকুক। কিন্তু এর পরিণাম কি তাঁরা ভেবে দেখেছেন?
আবার কেউ কেউ বলেছেন, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রার্থীদের অতি-উৎসাহী প্রচারণা, প্রাসঙ্গিক ভয়ভীতির হুমকি প্রদর্শন ইত্যাদি ভোটারদের মনে শঙ্কার সৃষ্টি মূলত ভোটার-স্বল্পতার কারণ। তাহলে কি বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে যে ভোটপ্রচারে মূল প্রার্থীদের অতিমাত্রায় জয়ের আস্থা ভোটারদের মনে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে, চিন্তাটা এ রকমই—কী হবে ভোট দিতে গিয়ে।
এ প্রসঙ্গেই কারো কারো আশঙ্কা—আমার ভোট আমি দিতে পারব তো? এই পরিবেশ-পরিস্থিতির অনিশ্চয়তাও ভোটার-মনে অনাস্থা তৈরির একটি কারণ। বাস্তবে এমন যে ঘটে না তা নয়। মোহাম্মদপুরের ভোটদানে অতি-উৎসাহী এক মহিলা ভোট দিতে গিয়ে ফিরে এসেছেন আঙুলের ছাপ মেলেনি বলে, এজাতীয় ঘটনা একাধিক।
আবার কেউ কেউ নিছক অশান্তির ভয়ে, ভোটকেন্দ্রে সম্ভাব্য গণ্ডগোলের আশঙ্কায় ভোট দিতে যাওয়ার বদলে ছুটির দিনটা ঘরে আরামে-আয়েশে ঘুমিয়ে কাটানোই প্রীতিপদ মনে করে ঘর থেকে বের হতে চাননি। প্রশ্ন উঠতে পারে, এজাতীয় দু-চারটি ঘটনা কি এর আগে ঘটেনি? তাহলে এবার হঠাৎ এমন ভোট-খরায় আক্রান্ত হলো কেন ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন? না কি অতীত অভিজ্ঞতা এর কারণ।
কারণ যা-ই হোক, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিত্বের বিচারে ঘটনাটি নানামাত্রায় বড় দুঃসংবাদের সংকেত দিচ্ছে। ৫০ শতাংশের নিচে ভোটার সমর্থন কি জনপ্রতিনিধিত্বের নির্দেশক বলে গ্রহণ করা যায়? সে জন্যই হয়তো একজন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য এ ঘটনাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অশনিসংকেত বিবেচনা করছেন। তাই বলি, ঘটনাটিকে রাজনৈতিক মহল যেন হেলাফেলায় গ্রহণ না করে, জনআস্থা অর্জনের দিকে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেয়। সেই সঙ্গে জনস্বার্থের দিকেও।
এ নির্বাচনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো—বিএনপি এ নির্বাচনে আয়োজন করে অংশগ্রহণের পর প্রচারে মেয়র পদের প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তিতে অংশগ্রহণের পরও ভোটের দিন ছন্নছাড়া ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো কেন? এ বিষয়ে একটি দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম : ‘এবারও মাঠ থেকে দূরে বিএনপি’। কেন এ যুক্তিহীন আচরণ? ভয়ে, চাপে, না কৌশলগত কারণে? অবশ্য বিএনপি নেতাদের এ বিষয়ে অভিযোগ বিস্তর, মূলত ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের পোলিং এজেন্টদের অনেক ভোটকেন্দ্রেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি, যাঁরা ঢুকেছেন তাঁদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এবং এ কাজটি করা হয়েছে নীরবে। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দখলে। তাদের দাপটের সামনে দাঁড়াতে পারেননি বিএনপি এজেন্টরা। কোথাও কোথাও তাঁদের এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয়—এমনই বক্তব্য উল্লিখিত প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন : একদা শক্তিমান একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মনোনীত এজেন্ট সবাইকে ‘নীরবে’ বের করে দেওয়া যায়, বিশেষ করে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে? তাঁদের সরব প্রতিবাদ উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত, যা সংবাদমাধ্যমের চমৎকার খোরাক হতে পারত। সেটা তাঁরা না করে নিঃশব্দে ঘরে ফিরে গেলেন কেন? যুক্তিবাদী রাজনীতি কি এমন শিক্ষা দেয়? সে ক্ষেত্রে অন্তত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবি করতে পারত না ক্ষমতাসীন দল এবং সমাজের কিছু বিশিষ্টজন। কয়েক হাজার ভোটকেন্দ্র এজেন্টহীন, এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা! এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী? এ ঘটনার দায় যেমন বিএনপির, তেমনি নির্বাচন কমিশনের এবং ক্ষমতাসীন দলের। ভোটার স্বল্পতার সর্বনেশে দায়ও রাজনৈতিক দলগুলোর, তার জনবিচ্ছিন্নতার পথে। আর ভোটার জনতার কি কোনো দায় নেই, নেই নেতির বদলে ইতিবাচক প্রতিবাদী পথে প্রাপ্য আদায়ের?
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> আইসিজের রায়ে কতটা বরফ গলবে?