করোনাভাইরাস: চীনের আকাশে বাতাসে বাঁচার আকুতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

করোনা ভাইরাস
ছবি : ইন্টারনেট

বেইজিংয়ের সরু গলিতে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন ল্যানিং কৌ। গত সাতদিনের মতো মঙ্গলবার সকালে তিনি রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন। করোনাভাইরাস-এর বিস্তার ঠেকাতে চীন সরকার নাগরিকদের বাড়িতে অবস্থানের পরামর্শ দেয়ার পর ল্যানিংয়ের আয় কমে গেছে। চীনা চন্দ্রবর্ষের ছুটি শেষে মানুষ কর্মস্থলে ফিরবেন; তখন বেশি গ্রাহক পাওয়া যাবে এমন আশায় মঙ্গলবারও রেস্তারাঁ চালু করেন তিনি।

তবে সেই সরু গলি এখন একেবারেই শান্ত-নীরব। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ের পৌর কর্মকর্তারা চন্দ্রবর্ষের ছুটি বাড়িয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করতে বলেছেন। একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে রাজধানী বেইজিংসহ অন্যান্য প্রদেশ এবং পৌরসভাকেও।

বেইজিং পৌর সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতের জন্য জরুরি সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যরা আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

এর মানে এ সময় পর্যন্ত গ্রাহক পাওয়া ল্যানিংয়ের জন্য কষ্টসাধ্য। কাঁদতে কাঁদতে বেইজিংয়ের সরু গলির এই নারী হোটেল মালিক বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে আসলেই আমার কোনো আয় নেই। আমি জানি না, এভাবে কতদিন বেঁচে থাকতে পারবো। আমি বাঁচতে চাই।

কিডনি বিকলের শেষ ধাপে রয়েছেন ল্যানিং এবং চার বছর ধরে তিনি ডায়ালাইসিস করে আসছেন। সন্তানহীন এই নারীর বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে। পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল তিনি। চিকিৎসার জন্য এখনও প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত তিনদিন হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। চিকিৎসককে দেখানোর জন্য প্রতিদিন আয় না হলে তিনি বেশিদিন বাঁচতে পারবেন না।

চীনের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মারাত্মক বিপর্যয় আনতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু ল্যানিংয়ের মতো দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এটি আরও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য বলছে, চীনের কুরিয়ার এবং নির্মাণখাতের মতো এ ধরনের বেসরকারি খাতে প্রায় ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন। অন্যরা স্বনির্ভর। স্থিতিশীল আয় অথবা চুক্তিভিত্তিক বীমা ব্যতীত যেকোনো অর্থনৈতিক মন্দায় প্রথম আঘাত আসে এই শ্রমিকদের ওপর।

চীনের স্ট্রোল ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক শাও অ্যান হুয়াং বলেন, প্রাদুর্ভাব রোধ এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাবের ব্যাপারে প্রচেষ্টা প্রবল করতে যে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়; তা ক্ষুদ্র অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের লড়াইকে কঠিন করে তোলে।

জুন জিয়াংয়ের ঘটনাটি আবার আলাদা। জিয়াংয়ের ক্ষেত্রে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ শুধু তার জন্য নয় বরং তার পুরো পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রাদুর্ভাবের বিস্তারের আগে তিনি উহানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু চন্দ্রবর্ষের ছুটি উপলক্ষে তিনি হুনান প্রদেশে তার বাড়ি আসেন। তারপরই উহান অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এখন অর্থ সংকটে পড়ায় পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগার ও মেয়েকে স্কুলে পাঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

উহানের আকাশচুম্বী অট্টালিকা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন জিয়াং। এ আকাশচুম্বী ভবনের নির্মাণকাজ করতে পেরে গর্ববোধ করে তিনি বলেন, আমি উহানের গ্রিনল্যান্ড সেন্টার তৈরিতে কাজ করেছি। সেখানকার নির্মাণ শ্রমিকরা দিনে অথবা ঘণ্টা হিসেবে পারিশ্রমিক পান। কাজ না করলে অর্থ মেলে না।

জিয়াং বলেন, সত্যি আমি যদি সেখানে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে যেতাম। কারণ আমার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া দরকার। হুনানে আমাকে কেউ কাজে নেবে না। এখানে সবাই আমাদের ভাইরাস হিসেবে দেখেন।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী জিয়াং। হুনানে কোনও কাজ না পেয়ে এভাবে আটকা থাকলে তার পুরো পরিবারকে অনাহারে থাকতে হবে।

সহায়তার প্রস্তাব

চীনের অর্থনীতির প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ জীবন-যাপন করাদের মধ্যে আছেন এই ল্যানিং এবং জিয়াং। বিশ্লেষকরা প্রান্তিক পর্যায়ের এমন নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা দেয়ার জন্য দেশটির সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। যাতে অবরুদ্ধ থাকাকালীন তারা স্বাভাবিক খাবারের নিশ্চয়তা পান।

সিনহুয়া ইউনিভার্সিটির ইকোনমি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হংজে রেন বলেন, প্রাদুর্ভাবের কারণে যাতে দেশের স্বল্প আয়ের এবং বেকার মানুষ স্থিতিশীল জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন; সেটি সরকারের নিশ্চিত করা উচিত।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয় সে ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত।

চীনা ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত বছর দেশটির মানুষের গড় নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ছিল মাথাপিছু ২২ হাজার ৮৩২ ইউয়ান (বাংলাদেশি দুই লাখ ৭৭ হাজার ১৩৩ টাকা)। কিন্তু দেশটির প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের আয় এর নিচে।

রেন বলেন, সরকার সংবেদনশীল গোষ্ঠীগুলোর ক্ষতি প্রশমনের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন; তা দ্রুত করা উচিত। সরকারি নীতিমালা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মানুষের জীবন তো থেমে থাকতে পারে না।

৬ কোটি মানুষের স্থলবেষ্টিত হুবেই প্রদেশে গত বছরের ডিসেম্বরে নতুন করোনাভাইরাস ২০১৯-এনকভ প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা হয়। তখন থেকে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে চীনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে বিশ্বের অন্তত ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৬৩ জন নিহত ও ২৮ হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও ভয়াবহ কোপ পড়েছে হুবেই প্রদেশে। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে চীনসহ বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত এবং প্রাণহানি যত হয়েছে তার ৯৭ শতাংশ হুবেইতে এবং সব রোগীর ৬৭ শতাংশও সেখানকার।

সূত্র : আলজাজিরা, ডেইলি মেইল।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে