রাবি ছাত্রীকে ধর্ষণ ও দৃশ্য ধারণ করে টাকা আদায়, প্রেমিকসহ গ্রেফতার ৫

রাজশাহী প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণ ও ভয়ংকর ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। ছাত্রীকে কয়েক দফা সেক্স করতে বাধ্য করে তা মোবাইল ফোনে ভিডিও করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনামতো ছাত্রীটির প্রেমিক তার বন্ধুদের দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এখানেই থেমে থাকা নয়, ভিডিও দেখিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে টাকা।

এ ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুর্বৃত্তরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ভারতীয় টিভির ক্রাইম সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোলের ধরনে পুরো ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

শনিবার ও রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র মাহফুজুর রহমান সারদসহ ৫ জনকে। মাহফুজ ছাড়া বাকিরা রাজশাহীর প্রাইভেট বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

আরএমপির মতিহার থানা পুলিশ সোমবার রাজশাহীর মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করে মূল অভিযুক্ত মাহফুজকে ২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। মতিহার থানার ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ জানিয়েছেন, মাহফুজুর রহমান সারদকে ২ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

অভিযুক্ত মাহফুজুর রহমান সারদ। ছবি : সংগৃহিত

পুলিশ ইতিমধ্যেই ওপেন সেক্স ও ধর্ষণের ভিডিও উদ্ধার করেছে। আরেক অভিযুক্ত বিশাল সরকারকে খুঁজছে পুলিশ। মামলার পর ছাত্রীটি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছেন।

মতিহার থানায় ছাত্রীর এজাহারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ২৪ জানুয়ারি অর্থনীতি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র মাহফুজুর রহমান সারদ তার বান্ধবীকে (ছাত্রী) ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কাজলার সাঁকারা এলাকার একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে যায়।

পরে পদ্মার তীর এলাকায় কিছু সময় ঘুরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা আবার মেসে ফিরে যায়। সেখানে কথাবার্তার এক ফাঁকে তার বন্ধু মাহফুজ রুমে আটকে তাকে ধর্ষণ করে। ওই সময় পূর্বপরিকল্পনামতো রুমে প্রবেশ করে মাহফুজের ৫ বন্ধু বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র রাফসান আহম্মেদ, প্লাবন সরকার, জয়, জীবন ও বিশাল তালুকদার।

ছাত্রীটি আগন্তক যুবকদের কাউকে আগে দেখেননি। যুবকরা নিজেদের পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে মাহফুজ ও ছাত্রীটিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে ছাত্রীটিকে মাহফুজের সঙ্গে কয়েকবার ওপেন সেক্স করতে বাধ্য করে। আর সেইসব দৃশ্য তারা নিজ নিজ মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ড করে।

ছাত্রীটির দেয়া প্রাথমিক জবানবন্দির বরাত দিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিহার থানার এসআই আবদুর রহমান জানান, ওই রাতে আগন্তক ৫ যুবক ছাত্রীটিকে মাহফুজের সঙ্গে অন্তত তিনবার ওপেন সেক্স করতে বাধ্য করে।

রাত আনুমানিক ২টার দিকে মেয়েটির কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে তারা। কিন্তু এত রাতে পরিবারের কাছে টাকা চাইতে পারেনি মেয়েটি। শেষে তার বান্ধবী ও অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিজের বিকাশ নম্বরে নিয়ে তা যুবকদের একজনের নম্বরে ট্রান্সফার করে দেন।

কারণ ওই সময় বিকাশের দোকান খোলা ছিল না। একপর্যায়ে ওই রাতেই ছাত্রীটিকে মেস থেকে বের করে দেয়া হয়। পরের দিন তার কাছে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করে তারা।

এদিকে গ্রেফতার হওয়া জয় ও জীবন শনিবার রাতে গ্রেফতারের পর রোববার বিকালে রাজশাহী মহানগর হাকিমের আদালতে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে তারা বলেছে, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মাহফুজ নিজেই। তারা পরস্পরের বন্ধু।

আগের দিন মাহফুজ, প্লাবন সরকার, রাফসান আহম্মেদ, বিশাল তালুকদার, জয় ও জীবন মিলে মেসে বসে পরিকল্পনা করে যে তারা মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করবে। মেয়েটির পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। ভালো টাকা পাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক মাহফুজ তার বান্ধবীকে ডেকে নিয়ে কিছু সময় পদ্মার ধারে ঘুরে বেড়ায়।

এরপর মেসে গিয়ে মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেক্স করা শুরু করে। পরিকল্পনা মাফিক তার বন্ধুরা পাশের রুমে অপেক্ষা করছিল। ঘটনা বুঝতে পেরে তারা মাহফুজের রুমে ঢুকে দু’জনকে অনেকটা আপত্তিকর অবস্থায় পেয়ে যায়।

এরপর নিজেরা পুলিশ পরিচয়ে ভয় দেখায়। একপর্যায়ে মাহফুজের সঙ্গে ছাত্রীটিকে তিনবার ওপেন সেক্স করতে বাধ্য করে এবং ৫ জনই নিজ নিজ মোবাইল ফোনে ভিডিওচিত্র রেকর্ড করে। ওই রাতে যে ১০ হাজার টাকা তারা মেয়েটির কাছ থেকে নিয়েছিল তার মধ্যে থেকে ৩ হাজার টাকা পরদিন মাহফুজকে দিয়ে আসে।

আরেক অভিযুক্ত জীবন তার জবানবন্দিতে বলেছে, মাহফুজ নিজেকে গরিব পরিচয় দিয়ে সচ্ছল পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপর পরিকল্পনামতো তারা এ ধরনের ব্ল্যাকমেইল করে। আগেও কয়েকটি মেয়েকে মাহফুজ ও তারা মিলে এমন ব্ল্যাকমেইল করেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, মাহফুজই হচ্ছে মূল হোতা। সে এমন ঘটনা আগেও করেছে অন্য মেয়েদের সঙ্গে। এ ধরনের ঘটনার কথা মাহফুজ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।

তবে আর কোন কোন মেয়ের সঙ্গে এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা পুরোপুরি উদ্ঘাটনের জন্যই তাকে ২ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বাকি ঘটনাগুলো জানা যাবে বলে মনে করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ আরও জানায়, ছাত্রীটি ঘটনার পরদিনই নিজ এলাকায় চলে যান। মানসিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পরিবারের কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। ২৭ জানুয়ারি রাতে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে মতিহার থানায় উপস্থিত হয়ে ৬ ছাত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রীটি অভিযোগ দায়ের করেন।

পরদিন এ বিষয়ে ৬ ছাত্রের বিরুদ্ধে মতিহার থানায় মামলা হয়। এসআই আবদুর রহমান আরও জানান, ছাত্রীটির ফরেনসিক পরীক্ষা ইতিমধ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে সম্পন্ন হয়েছে। তবে প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাধ্যমে ৬ আসামির নাম-ঠিকানা ও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। মূল অভিযুক্ত মাহফুজুর রহমানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়; জয় ও প্লাবন সরকারের বাড়ি জয়পুরহাট, রাফসান আহম্মেদের বাড়ি রাজশাহীর বহরমপুর মহল্লায়, জীবনের বাড়ি রাজশাহীর কাজলায় এবং বিশাল তালুকদারের বাড়ি নাটোর।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে