বিত্তহীনদের জন্য একটি উচ্চমান হাসপাতাল কি অসম্ভব?

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার এখন ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সরকারি-বেসরকারি স্তরে অনেক মেডিক্যাল কলেজ বিভাগীয় শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত—রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট হয়ে মায় বাজিতপুর পর্যন্ত। কলেজগুলোর সঙ্গে যুক্ত হাসপাতালসংশ্লিষ্ট অঞ্চলে চিকিৎসাসেবার প্রসার ঘটিয়েছে, তবে কোন স্তর পর্যন্ত?

স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি শীর্ণকায় ‘ভার্টিকাল’ চরিত্রের, হরাইজন্টাল গণমুখী প্রকৃতির নয়। তাই ক্ষুদ্র শতাংশ শ্রেণিবিশেষের অবিশ্বাস্য বিপুল মাত্রায় অর্থনৈতিক স্ফীতি, যা সুযোগসন্ধানী ভোগবাদী সামাজিক আদর্শে লালিত। বহু কথিত জনসেবা নির্বাসনে, যেমন চিকিৎসাসেবা খাতে, তেমনি শিক্ষা খাতে। দুর্মূল্য চিকিৎসাসেবা বা শিক্ষা মূলত বেসরকারি খাতে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান—এককথায় চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণই বর্তমান সমাজের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি খাতের মেডিক্যাল শিক্ষায়তন ও হাসপাতাল যেহেতু দ্রুত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছে না, তাই সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে বাণিজ্যকরণের ব্যাপক বিস্তার-শিক্ষায়তন, ক্লিনিক, হাসপাতাল ও অনুসন্ধানী পরীক্ষাগারের মাধ্যমে। একটি নিরপেক্ষ বিজ্ঞানসম্মত জরিপ এ বিষয়ে প্রকৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরতে পারবে।

এটা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বাস্তব শ্রেণিগত প্রতিফলন বলা চলে। সেই সঙ্গে শ্রেণিগত বৈষম্যেরও প্রকাশ খুবই স্পষ্ট। সমাজের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে প্রধানত ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী শ্রেণির উল্লেখ করা চলে। রবীন্দ্রনাথ একবার তাঁর স্বভাব ব্যতিক্রমে, কী ভেবে জানি না, বিশ্ব শ্রেণি পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় লিখেছিলেন—আরেকটা লড়াই সামনে রহিল—সেটা মহাজনে-মজুরে, বৈশ্যে-শূদ্রে।

আসলে লড়াইটা হলো বিত্তবানের সঙ্গে বিত্তহীনের, ধনী-অতি ধনীর সঙ্গে নির্ধনের। রাজনৈতিক ও সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম শ্রেণিসংগ্রাম। পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ স্তরে সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছে যাওয়ার পর নিয়মমাফিক শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করার কথা। পরিবর্তে বিশ্বজুড়ে সে সংগ্রাম নির্বাসনে যাওয়ার পথে। এর প্রভাব বাংলাদেশি সমাজে পড়তে বাধ্য—পরিস্থিতি দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ শেষোক্ত পথেরই যাত্রী।

দুই.

শুরুতে অবস্থা এ দেশে অন্য রকমই দেখা গিয়েছিল, বিশেষ করে ছাত্রসমাজে, পঞ্চাশের দশক থেকে। সারা পূর্ববঙ্গ প্রদেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি মাত্র উচ্চ মেডিক্যাল শিক্ষায়তন, নাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও প্রতিষ্ঠা ১৯৪৬ সালে। চল্লিশের দশকের শেষ দিক থেকে পঞ্চাশের দশকে যে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সূচনা তার প্রকাশ ঢাকা মেডিক্যাল ছাত্রদের বড়সড় অংশে দেখা গেছে। ক্রমে তা বেড়েছে তীব্র আকারে ষাটের দশকে, একাত্তরে এর সর্বোচ্চ প্রকাশ।

পঞ্চাশের দশকে শিক্ষা ও হাসপাতালের হাঁটি হাঁটি অবস্থার মধ্যে ৪৫ বছর বয়সী হাসপাতাল ভবনটির স্থাপত্যশৈলী ছিল আকর্ষণীয়, সুঠাম কাঠামোর। বঙ্গভঙ্গ আমলের নতুন প্রদেশের (আসাম-বঙ্গ) সচিবালয় পাশের রাস্তাটির নাম একালেও সেক্রেটারিয়েট রোড। লাল রঙের কার্জন হল এখনো সেই স্মৃতি বহন করছে। যেমন—করছে রমনার অন্য ভবনগুলো।

পঞ্চাশে প্রকাশিত প্রথম কলেজ ম্যাগাজিনটি তখনকার মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক মনন ও সচেতনতার প্রকাশ ধরে রাখে কিছু কথায়—যেমন ‘আজ ঝড়পরধষ সবফরপরহব এই শিক্ষাই দিয়েছে যে মানুষই মানুষের শত্রু, রোগজীবাণু নহে।’ আক্ষেপ করা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধগুলো বাংলা ভাষায় ছাপতে না পারার জন্য। আগেকার কথাটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিচারে। এতে শ্রেণি-বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট।

বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পদে পদে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে, যখন তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিছক আপন রাষ্ট্রিক স্বার্থে আগ্রাসী আক্রমণ চালাচ্ছে, দখল করছে ভূগর্ভস্থ তেলভাণ্ডার লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক যুদ্ধ এমন প্রমাণই রেখেছে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক আগ্রাসী আচরণে। ঠিকই মানুষই মানুষের শত্রু। প্রবলের হাতে দুর্বলের মৃত্যু।

এমন উপলব্ধিও এতে উঠে এসেছে যে বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী ক্ষমতাসীনের আজ্ঞাবহ তাদের সঙ্গে আপস করতে সদা প্রস্তুত। তাই চিকিৎসাসেবা বিত্তহীন স্তরে পৌঁছাতে পারছে না। হাসপাতাল সেবা থেকে বঞ্চিত একজন বিত্তহীন মানুষের ছবি ছাপার কারণে ওই কলেজ ম্যাগাজিনটি অধ্যক্ষের নির্দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে উচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতার নানাবিধ আন্দোলন উল্লিখিত প্রথম পর্বের, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্ররা সংগ্রামী চেতনার স্বাক্ষর রেখেছে, রচনা করেছে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাস অবশ্য তাদের ছাত্রজীবনের বার্তা যেমন সর্বজনীন স্বার্থের সংগ্রামে, তেমনি ব্যক্তিজীবনে মেধার অসামান্য প্রকাশে। রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চায়।

তিন.

এ ধারাবাহিকতা ষাটের দশককে আরো সমৃদ্ধ করেছে, বিশেষভাবে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সচেতনায়। যেমন—আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করতে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী রাজনীতির দুই ধারায়, তেমনি সংস্কৃতির প্রগতিবাদী চর্চায়। যেমন—রবীন্দ্র-নজরুল-ইকবালের গানে, তেমনি চিকিৎসাসেবাকে গণমুখী আদর্শে বাস্তবায়িত করার আহ্বানে।

এ দশকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সক্রিয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি বড়সড় অংশ একদিকে প্রগতিবাদী রাজনীতি সংস্কৃতি, অন্যদিকে চিকিৎসাসেবাকে গণমুখী চরিত্রে উন্নীত করা অর্থাৎ চিকিৎসাসেবাকে যথাযথ মানে জনগণের দাওয়ায় পৌঁছে দেওয়ার কার্যকরী আদর্শের প্রতীকী বাস্তবায়নের আহ্বানে তৎপর হয়ে উঠেছিল।

তাই ছাত্রাবাসে ওই আদর্শে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, রমেশ শীলের কবিগান, গণমুখী চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনাসভা, একইভাবে ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র নিয়ে বিতর্কসভার আয়োজন—এসবের ঘনঘটা তাদের পাঠসূচির পাশাপাশি ছাত্রজীবনকে আদর্শবাদের রঙে রাঙিয়েছে। এসবের সর্বশেষ পরিণাম উনসত্তর থেকে একাত্তর—ছাত্রসমাজের ব্যাপক কর্মে ও আত্মদানে, শহীদের মর্যাদা অর্জনে।

সময় তো বহতা নদী। তেমনই জীবন-যৌবন। এই ছাত্ররাই জীবিকার টানে, প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রামে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যে যার মতো করে জীবনে যশ-খ্যাতি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে, পেছন ফিরে তাকানোর অবসর ছিল না তখন। একসময় আত্মপ্রতিষ্ঠার স্থিতাবস্থায় কারো কারো মনে হয়েছে অতীতদিনের কথা, কারো মনে হয়েছে ছাত্রজীবনের আদর্শবাদের কথা।

এর অন্তত দুটো উদাহরণ স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে জনমুখী স্বাস্থ্যসেবার টানে সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার, গণসুবিধার ওষুধ সংস্থা স্থাপনের বা অনেক পরে শহর ঢাকায় একই ধারায় নগর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। তেমনি অন্য হাতে মালিবাগে প্রায় একই চিন্তার কমিউনিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাও ভিন্ন উদাহরণ। কিন্তু ওই আদর্শবাদীদের মনে হয়নি মহানগর ঢাকায় বিত্তহীন, বস্তিবাসী, দরিদ্র মেহনতি মানুষের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি উচ্চমানসম্পন্ন দাতব্য হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা। ভাবা হয়নি, দরিদ্র পরিবারে একজন রোগীর চিকিৎসায় তাদের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা।

চার.

ব্যতিক্রমী ধারায় ষাটের দশকে ছাত্রদের ১৯৬৪ সালের ব্যাচের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী যারা জীবনে সমৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে, তারা স্মৃতিকাতরতার টানে মাঝেমধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে একত্র হয়। নিউ ইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনের মতো দূরদেশ থেকে কারো কারো আসা দিনকয় হার্দ্য আলাপে, ছাত্রজীবনের সোনালি দিনগুলোর স্মরণে আবেগঘন হয়ে উঠে তারুণ্যের স্বপ্নে ফিরে যাওয়া। তাদের কারো ভাষায় ‘শিকড়ের টানে’।

মাত্র কয়েকটি দিন। জীবনের অপরাহ্নবেলায় তারুণ্যের স্মৃতিচারণায় কিছু উষ্ণতা, কিছু প্রাণশক্তি সঞ্চয় কি এই সাময়িক মিলনের উদ্দেশ্য, নাকি কিছুটা ব্যতিক্রমী সময়যাপন, যাকে বলে ডাইভারসন। নিহিত উদ্দেশ্য যা-ই হোক, এঁরা নিয়মিতই এই মিলনমেলার কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন। এবার ছিল তাদের ব্যাচের (১৯৬৪) ডিগ্রি অর্জনের পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তী—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে একত্র হওয়া, কলেজ অধ্যক্ষের উদার আমন্ত্রণে ও আপ্যায়নে ঘণ্টা তিনেক উষ্ণ সময় কাটানো।

আমার সুযোগ হয়েছে ৭০ বছর আগেকার শিক্ষায়তনে ১৫ বছরের অনুজদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার, তাদের কলরবমুখরতার মধ্যে। এ অনুষ্ঠানের প্রধান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন নাহারের আমন্ত্রণে সেখানে যাওয়া, নতুন পরিচয়, পুরনো পরিচিত কারো কারো সঙ্গে দেখা—যেমন কাজী তামান্না, ফওজিয়া, স্নিগ্ধা প্রমুখ। সঙ্গী নিউ ইয়র্কপ্রবাসী মেধাবী ছাত্র হুমায়ুন কবির। এ ছাড়া আরো দু-একজন দেখা দীর্ঘকাল পর।

এ মহতি মেলায় পুরনো দিনগুলোর স্মরণে একটি প্রস্তাব, পূর্বোক্ত গণচিকিৎসাসেবা প্রসঙ্গে যা ঢাকার সমৃদ্ধিতেও অনর্জিত—বস্তিবাসী, বিত্তহীনদের জন্য একটি উচ্চমান দাবত্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। যেটা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ১৯৬৪ ব্যাচের বিত্তবান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেষ্টায় সম্ভব হতে পারে। দাবি আদায়ের মতো স্লোগানের ভাষায় বলা—‘৫ টাকা ১০ টাকার টিকিট কেটে উচ্চমান চিকিৎসাসেবার একটি দাবত্য হাসপাতাল চাই বিত্তহীনদের জন্য।’

রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীভূত বিপুল ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির মধ্যে এত দিনেও তেমন একটি বিত্তহীনমুখী দাবত্য হাসপাতাল তৈরি হয়নি, কী ‘বিলিয়নেয়ার’ ওষুধ কম্পানি বা বিত্তবান পেশাজীবী চিকিৎসকদের দাক্ষিণ্যে—যে হাসপাতাল তাঁদের মহতি প্রচেষ্টাকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে পারে। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ মহোদয় এবং জনাকয় ১৯৬৪ ব্যাচ প্রবীণ-তরুণের আগ্রহ দেখা গেলেও আপাত সর্বজনীন সাড়া লক্ষ করা যায়নি। আমি অবাক হয়েছি।

মিলনমেলা থেকে ফেরার পথে ভাবনা—এরা তো এখানে এসেছে তারুণ্যের দিনগুলোর স্মরণে ও আকর্ষণে। তাহলে আদর্শের ভাবনাগুলোর একটিকে কি জীবনের শিলালিপিতে খোদাই করে রেখে দেওয়া যায় না, যা তাদেরও স্মরণীয় করে রাখবে—রাখবে একটি হাসপাতাল?

লেখক : কবি, গবেষক ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে