ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে নিত্যপণ্যের বাজার। পর্যাপ্ত উৎপাদন, আমদানি, মজুদ থাকার পরও এরই মধ্যে চাল, ভোজ্য তেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। আসছে রমজান মাস ঘিরে ছোলা, মটর ডালসহ আরো কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা।
চীনের করোনা ভাইরাসে ‘আমদানি বন্ধের’গুজব ও অজুহাত তুলে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ানোরও অপচেষ্টা আছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) এক গোপন প্রতিবেদন এসব বিষয় উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে রমজান মাসে ব্যবসায়ীরা যাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া না বাড়াতে পারেন, সে জন্য অসৎ ব্যবসায়ীদের নজরদারিতে আনা, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া এবং টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকিতে পণ্য বিক্রির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, দেশে কিছু কিছু পণ্যের মজুদ চাহিদার চেয়ে বেশি। এর পরও বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তি। গত ১০ দিনে চাল প্রতি কেজি তিন-আট টাকা, ডাল ১০-১৫ টাকা, পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকা, রসুন ৪০-৫০ টাকা, ভোজ্য তেল আট-দশ টাকা, চিনি তিন-চার টাকা বেড়েছে। আর এর প্রধান কারণ অসৎ মিল মালিক, আড়তদার ও আমদানিকারকরা। তেলের দাম বাড়াতে মিল মালিক থেকে পাইকারি বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে তেলের বারবার হাত বদল করেন। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে কিছু পণ্যের মজুদ করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ মত ও পথকে বলেন, এফবিসিসিআই প্রতিবারের মতো এবারও রমজানের বাজারে যেন ভোগ্য পণ্যের দাম না বাড়ে সে জন্য মনিটর করবে। তবে আমরা এখন চীনে করোনা ভাইরাস ঘটনার কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে চিন্তিত। চীনের কারখানাগুলোয় উৎপাদন শুরু না হওয়ায় সামনে স্থানীয় বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছি।
চাল
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমনের মৌসুমে ফসল ঘরে ওঠার পর কৃষকের হাতে থাকাকালে বাজারে চালের মূল্য স্থিতিশীল ছিল। ধান কৃষকের হাত থেকে মিল মালিক ও আড়তদারদের হাতে চলে যাওয়ার পরই চালের দামের ঊর্ধ্বগতি ঘটছে।
ভোজ্য তেল
গত ১০-১১ দিনে বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আট-দশ টাকা বেড়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে সয়াবিনের পাইকারি মূল্য ছিল প্রতি লিটার ১০০-১০২ টাকা (বোতলজাত) ও খুচরা মূল্য ১০৫-১০৬ টাকা। খোলা তেলের খুচরা মূল্য ছিল লিটার ৮৭-৮৮ টাকা। বর্তমানে সয়াবিনের পাইকারি মূল্য লিটার ১০৫-১০৭ টাকা, খুচরা ১১৩-১১৫ টাকা। এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্ন্তজাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় আমদানিকারক ও এজেন্টরা তেলের দাম বাড়ান। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তাঁরা কমান না। বর্তমানে বাজারে সরবরাহকৃত ভোজ্য তেল অন্তত ১০ থেকে ৪৫ দিন আগে আমদানি করা। এ ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই।
চীন বিশ্বে ভোজ্য তেল আমদানিকারকের তালিকায় শীর্ষে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চীনে তেল আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম প্রতি কেজিতে সাড়ে সাত টাকা কমেছে। মালয়েশিয়ায় পাম তেলের দাম ৮৫০ ডলার থেকে ৭২০ ডলারে নেমেছে। সয়াবিনের দাম ৯০০ ডলার থেকে ৮১০ ডলারে নেমেছে।
পেঁয়াজ
দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। দেশে গড় উৎপাদন ১৬ লাখ টন। চাহিদার বাকি আট-দশ লাখ টন আমদানি করতে হয়। গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৩৬-৪০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এক মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম বাড়ে, যা একপর্যায়ে কেজি ২২০-২৩০ টাকায় ওঠে। এপ্রিল মাসে রমজানের সময় পেঁয়াজের ভরা মৌসুম থাকলেও দেশের উৎপাদন দিয়ে বিগত ঘাটতি পূরণ করা কঠিন হবে। কারণ রমজানে অন্যান্য মাসের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থাৎ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টন পেঁয়াজের প্রয়োজন হবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে পেঁয়াজ দেশে পৌঁছতে যে সময়ের প্রয়োজন হবে, তাতে সরবরাহ ঘাটতির পাশাপাশি জনমনে অহেতুক আতঙ্কের কারণে রমজানে দর প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
চিনি
চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের তথ্য মতে, দেশে চিনির বছরে চাহিদা ১৬ লাখ টন। সে হিসাবে প্রতি মাসে চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন। তবে রমজানে চাহিদা দুই থেকে আড়াই লাখ টন হয়। চিনিকলগুলোর গোডাউনে বর্তমান মজুদ ৫৬ হাজার টন। চিনি রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, এ বছর তারা ১২ লাখ টন চিনি উৎপাদন করবে।
বিআইএসএফের তথ্য মতে, দেশের বাজারে চিনির ঘাটতি নেই। তবে রমজানে বাড়তি চাহিদা মেটাতে রিফাইনারি মিলগুলোর উৎপাদন যথাযথ পর্যায়ে রাখাসহ সরকারি মিলগুলোর গোডাউন থেকে চিনির বাজারজাতকরণ পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে করা প্রয়োজন। অন্যথায় রিফাইনারি মিল মালিকরা সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে সংকট তৈরি করতে পারেন।
ছোলা, মটর ও ডালজাতীয় ভোগ্য পণ্য
বাজারে গত ১০ দিনে মসুর ডালের মূল্য কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। পাইকারি মূল্য ১০৫-১১০ টাকা এবং খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়। রমজান সামনে রেখে অতি চাহিদাসম্পন্ন ভোগ্য পণ্য ব্যাপক হারে আমদানি হচ্ছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা ছোলা, ডালজাতীয় পণ্যের প্রচুর এলসি করেছেন এবং এরই মধ্যে শিপমেন্টও হয়েছে। রমজানে ছোলার চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন, অন্যান্য মাসে থাকে ১০-১২ হাজার টন। রমজানে মসুর ডালের চাহিদা ৭৫-৮০ হাজার টন। আন্তর্জাতিক বাজারেও ছোলাসহ ডালজাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে রমজান মাস সামনে রেখে ছোলা ও ডালজাতীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
- নাইজেরিয়ায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ‘লাসসা জ্বরে’ ৭০ জনের মৃত্যু
- খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কাদের-ফখরুল ফোনালাপ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রসুন, আদা ও মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি করা হয়। চীনে সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের কারণ দেখিয়ে ‘আমদানি বন্ধ থাকার’অজুহাত বা গুজব তুলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে রসুনের দাম কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা, আদা কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকা, এলাচ কেজিপ্রতি ৮০০-১০০০ টাকা ও দারুচিনি কেজিপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা বাড়িয়েছেন। আমদানির বিকল্প বাজার সৃষ্টি না করলে রমজানে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।