করোনার প্রথম প্রতিষেধক পেল যুক্তরাষ্ট্র!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

করোনাভাইরাস
ফাইল ছবি

রবিন অ্যাডিসনের কাছে গত ২০ জানুয়ারি সোমবার রাতটি অন্যান্য রাতের মতোই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের এভারেট প্রোভিডেন্স রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারের নিজের কাজ শেষে বাসায় ফিরে পাজামা পরেই বিছানায় যান; ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার দিকে এক সহকর্মী নার্সের টেলিফোন পান তিনি।

তিনি যতদূর মনে করতে পারেন, ফোন করে সারাহ উইলকারসন তাকে বলেন, ‘রবিন, আমি মনে করছি, আমাদের ইউনিট আবার খোলা দরকার।’ ইউনিটটি একটি পপ-আপ বায়োহ্যাজার্ড চেম্বার; যা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত কাউকে পৃথকীকরণের (কোয়ারেন্টাইন) জন্য তৈরি করা।

ইবোলা আক্রান্ত রোগীর কথা মাথায় রেখে ২০১৫ সালে খোলা হলেও, গত চার বছর ধরে কখনও সেটি ব্যবহার করা হয়নি। উইলকারসন হলেন হাসপাতালের ইনফেকশন প্রিভেনশন ম্যানেজার। তিনি রবিনকে ব্যাখ্যা করেন, স্থানীয় এক ব্যক্তি নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; যিনি যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি।

এমন কথা শোনার পর অ্যাডিসন তার কাঁথা-কম্বল রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন, তারপর সোজা চলে যান হাসপাতালে। যখন ওয়াশিংটনের স্নোহোমিশ কাউন্টির ওই করোনা আক্রান্ত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করা হয়; তখন এ ভাইরাস এবং বিস্তার সম্পর্কে সামান্য কিছুই জানা গেছে। এটার কোনও প্রতিষেধক কিংবা টিকাও আবিষ্কার হয়নি।

নতুন করোনাভাইরাস যার আনুষ্ঠানিক নাম সার্স-কভ-২। এ ভাইরাস আক্রান্ত হলে যে রোগ হয় তার নাম কোভিড-১৯। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে ৭১ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৭ শতাধিক। যার বেশিরভাগই চীনের নাগরিক। দুই ডজনের বেশি দেশে এখন এ ভাইরাস ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম যে ব্যক্তি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন, তার নাম প্রকাশ না হলেও বয়স বলা হচ্ছে ৩৫ বছর। তিনি সম্প্রতি চীন সফর করেন। গত ১৫ জানুয়ারি সিয়াটল-টাকোমা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে যে ১১টি বিমানবন্দরে যাত্রীদের ক্লিনিক্যাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে, তার মধ্যে এটি একটি।

তিনি যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখনই তার সামান্য জ্বরের সঙ্গে শুষ্ক কাশি শুরু হয়। করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানার পরপরই তিনি জরুরি সেবাদানকারী একটি ক্লিনিকে যান। এরপর স্নোহোমিশ হেলথ ডিস্ট্রিক্ট তার শরীর থেকে পাওয়া নমুন আটলান্টায় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রে (সিডিসি) পাঠায়; ফলাফল আসে তিনি করোনাভাইরাস পজিটিভ।

তার পরই হাসপাতাল থেকে ডাক আসে অ্যাডিসনের। করোনা আক্রান্ত এই রোগীকে হাসপাতালের ওই ইউনিটে ভর্তি করা হয়, যেখানে এর আগে কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। এরপর অ্যাডিসন এবং উইলকারসনসহ হাসপাতালের সবচেয়ে সেরাদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। যাতে ঠাঁই হয় বিশেষজ্ঞ সব চিকিৎসকের।

উইলকারসনের কাছ থেকে অ্যাডিসন ফোন পাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পর বায়োহ্যাজার্ড টিম আইসোলেশন ইউনিট তৈরি করে। করোনা আক্রান্ত ওই ব্যক্তিকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়। সরানো যেতে পারে এমন দেয়াল দেয়া হয় সেখানে। পাশাপাশি যাতে বাতাস কোনোভাবে ভেতর থেকে বাইরে যেতে না পারে সে ব্যবস্থাও করা হয়।

হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করার পর ওই বিভাগের প্রধান দিয়াজ পাশের কক্ষ থেকে ‘টেলি-হেলথ সিস্টেম’ ব্যবহার করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। মূলত ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীর সঙ্গে কথা বলা ও রোগীকে দেখার মাধ্যমে এ কাজ করেন তিনি।

পরে সেখান থেকে রুটিনমাফিক অনেক কাজ করা হয়। তিনজন চিকিৎসক আর হাসপাতালের সবদিক থেকে নার্স নিয়ে ২০ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়; যারা পালাক্রমে ওই রোগীর দেখাশোনা করেন। রোগীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সর্বশেষ অবস্থার খোঁজ রাখেন তারা। এছাড়া তাকে নিয়মিত ইন্ট্রাভেনাস থেরাপি (আইভি) দেন।

কিন্তু মেডিকেল টিমকে এ কাজে সুরক্ষার জন্য যা পরতে হচ্ছিল; তাতে তাদের কাজ কঠিন হয়ে যায়। তাদের রেসপিরেটরি হেলমেট পরতে হয়, যাতে ছিল প্লাস্টিকের সেফগার্ড। তারা দ্বিগুণ গ্লাভস পরা শুরু করেন। এতে এমন এক পরিস্থিতির তৈরি হয়; যাতে একজন নার্সের পক্ষে চার ঘণ্টার বেশি ডিউটি করা সম্ভব হয় না।

অ্যাডিসন বলেন, ইন্ট্রাভেনাসের থেরাপি দেয়ার মতো আমরা প্রতিদিন যা যা করছিলাম তাতে মনে হচ্ছিল যে, অবস্থা বেশ জটিল। আমাদের দুই জোড়া গ্লাভস পরতে হচ্ছিল। এটা তো ছিল ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের কাজ। কিন্তু আমাদের সব করতে হচ্ছিল। এমন সুরক্ষিত পোশাক-পরিচ্ছদ আমাদের শিরাগুলোকেও মুক্তি দিচ্ছিল না।

এর পাঁচদিন পর করোনা আক্রান্ত ওই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ষষ্ঠ দিন তাকে অক্সিজেন দেয়ার প্রয়োজন পড়ে এবং তার ফুসফুসের এক্স-রে করা হয়। দেখা যায়, রোগীর শরীরে নিউমোনিয়া বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। এই নিউমোনিয়া হলো করোনাভাইরাসের অন্যতম উপসর্গ।

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের চিকিৎসকদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করে ওই বিভাগের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসনের কাছ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ‘রেমডেসিভির’ অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগের অনুমোদন পান। ইবোলা আক্রান্ত রোগীর জন্য তৈরি করা এ পদ্ধতি নিরাপদ প্রমাণিত হলেও ভাইরাস নির্মূলে ফলপ্রসূ হয়নি।

তবে গবেষকরা মার্স-করোনাভাইরাস হয়েছে এমন বানরের ওপর প্রয়োগের পর সফলতা পেয়েছেন। চীনও কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী নতুন এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলকভাবে একটি অ্যান্টিভাইরালের ব্যবহার শুরু করেছে, যেটি ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক গিলিড ফার্মাসিটিউক্যালসের তৈরি।

ফ্যাপিলাভির নামে আরেকটি অ্যান্টিভাইরাল নভেল করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করতে সক্ষম বলে তা বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়েছে চীনের ঝেঝিয়াং প্রদেশের সরকার। চীনে এটাই প্রথম অ্যান্টি-নভেল করোনাভাইরাস প্রতিষেধক; যা চীনের ন্যাশনাল মেডিকেল প্রোডাক্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেরও অনুমোদন পেয়েছে।

হাসপাতালটির যে বিভাগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা চলছিল তার প্রধান দিয়াজ বলেন, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের অনুমোদন পাওয়ার পর তিনি যে অ্যান্টিভাইরাল ব্যবহারের অনুমোদন পান তা ওই রোগীর ওপর প্রয়োগের কয়েক দিন পর তার জ্বর কমতে শুরু করে এবং তিনি সুস্থ বোধ করেন।

পরে রোগীকে হাসপাতাল থেকে কত দিন পর ছেড়ে দেয়া যাবে সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য দিয়াজ সিডিসির চিকিৎসকদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে শুরু করেন। ছেড়ে দেয়ার পর কীভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হবে; তা নিয়েও ভাবতে শুরু করেন তারা। গত জানুয়ারি ৩১ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই রোগী বাড়ি ফেরেন।

তিনি জানান, এ চিকিৎসা পদ্ধতি অন্যদের ক্ষেত্রে কতটা ভালোভাবে কাজ করবে তা নিয়ে আগাম কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এর ফল খুবই আশা জাগানিয়া। মার্কিন এ চিকিৎসক বলেন, ‘এটাই করোনাভাইরাসের চিকিৎসা হিসেবে প্রথম এবং একমাত্র সফলতা হলেও এ পদ্ধতি যে কাজ করছে তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে।’

সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, চায়না ডেইলি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে