শত্রুও যদি অসুস্থ হয়, মরণাপন্ন রোগে আক্রান্ত হয়—মানুষ তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, তার আরোগ্য কামনা করে। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, শত্রু নন (যদিও তাঁর এবং তাঁর দলের ভূমিকা শত্রুতার)। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। শত্রুতা থাকে না; কিন্তু খালেদা জিয়া এবং বিএনপির রাজনৈতিক ভূমিকাই ছিল আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা—এমনকি স্বাধীনতার মূল আদর্শগুলোর প্রতি শত্রুতার। তাদের এই ভূমিকা এখন পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা এখন প্রমাণিত। তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া স্বামীর মৃত্যুর পর বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করে একই হত্যার রাজনীতি চালান। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কেউ প্রতিপক্ষকে হত্যা করে না। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিপক্ষকে হারায়। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করে সমূলে বিনাশ করে দেওয়ার।
স্বয়ং শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদসহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে বিএনপি এবং তার মৌলবাদী সহযোগীদের সংশ্লিষ্টতা আজ মানুষের কাছে স্পষ্ট। নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমায় কত শত নিরীহ নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তার সংখ্যা গণনা করে কে?
ভারতে শুধু তাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল একা নাথুরাম গডসে। সে জন্য গোটা হিন্দু মহাসভা নামক রাজনৈতিক দলটিকে নেহরু সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আর বাংলাদেশে যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং যে দলটি পরবর্তীকালেও দেশে হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি চালিয়েছে, সেই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দলটির নেতাদের রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বিচারে সোপর্দ করলে কি অন্যায় হতো?
আজকের লেখায় কিছু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলাম এ জন্য যে খালেদা জিয়া কারাগারে গুরুতর অসুস্থ; এ জন্য তাঁকে মানবিক কারণে জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক অথবা প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হোক—এই প্রচারণা চলছে। যদি সত্যিই তাঁর রোগ গুরুতর হয়ে থাকে (ডাক্তাররা তা বলছেন না) তা বিবেচনা করে মহামান্য আদালত যদি জামিন দেন কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্যারোলে মুক্তির আবেদন গ্রহণ করেন, তাহলে কারো কিছুর বলার নেই। আমার কথা, খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে তাঁর দল এবং পরিবারও মানবিক কারণ কথাটি বারবার উল্লেখ করছে; কিন্তু তাদের ‘নারীঘাতী, শিশুঘাতী’ রাজনীতির সময় এই মানবিক চেতনা ও মানবতাবোধ কোথায় ছিল?
বিএনপি আদালতে তাদের নেত্রীর জামিনের আবেদন করবে অথবা এরই মধ্যে করে ফেলেছে। আদালত সব দিক ভালোভাবে বিবেচনা করে জামিন দেবেন কি না তা আমি জানি না। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে আদালতের এখতিয়ারভুক্ত; কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যদি মানবিক কারণ দর্শিয়ে প্যারোলে মুক্তির আবেদন জানানো হয় তাহলে বিদেশ থেকে ডাক্তার আনিয়ে আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে তাঁর রোগ সত্যিই গুরুতর কি না। না, এই অসুস্থতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি সত্যই গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্যারোলের আবেদন (যে আবেদন এখনো করা হয়নি, মুখে মুখে বলা হচ্ছে) বিবেচনা করতে পারেন।
অন্যথায় গুরুতর অসুস্থতার অজুহাত খাটিয়ে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে তিনি তাঁর পুত্রের মতো অনির্দিষ্ট কাল থেকে যাওয়ার এবং বিদেশে বসে সরকার উচ্ছেদের ‘ওহি’ পাঠাতে শুরু করবেন না—তার গ্যারান্টি কোথায়? এভাবে তিনি তাঁর অপরাধের আদালত প্রদত্ত শাস্তিও এড়িয়ে যাবেন।
অসুস্থতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের উদাহরণ প্রাচীন ও মধ্য যুগে যেমন ছিল, বর্তমান যুগেও তেমনি আছে। মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর শিবাজি সন্ধির প্রস্তাব দেন; কিন্তু অসুস্থতার জন্য নিজে সন্ধির প্রস্তাব আলোচনা করতে আসতে পারবেন না জানিয়ে মোগল সেনাপতি আফজাল খানকে তাঁর আবাসে আমন্ত্রণ জানান। আফজাল খান সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ধূর্ত শিবাজি প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর বুকে লুকানো ছিল বাঘনখ নামক মারাত্মক অস্ত্র। শিবাজি কোলাকুলির নামে আফজাল খানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঘনখ দ্বারা হত্যা করেন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে পাঠকদের জানাই, আফজাল খানকে শহীদ ঘোষণা করে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর সেনাপতির নিহত হওয়ার শহরটির নাম রাখেন আফজলনগর। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির সরকার এই শহরের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
এ যুগেও অসুস্থতার রাজনীতির উদাহরণ আছে। গত শতকের গোড়ার দিকে আইরিশ নেতা ডি ভ্যালেরা ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি মুক্তিলাভের কোনো উপায় না দেখে কারা কর্তৃপক্ষকে জানালেন, তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাঁর বন্ধুবান্ধবদের শেষ দেখা দেখতে চান। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর অনুরোধ রাখল। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দেখতে কারাগারে এলেন। তাঁরা কৌশলে জেলের মেইন গেটের তালার মাপজোখ নিয়ে গেলেন। আর সেই তালার চাবি বানিয়ে কেকের মধ্যে ঢুকিয়ে বড়দিনের উপহার হিসেবে পাঠান। সেই চাবি দিয়ে জেলের গেট খুলে ডি ভ্যালেরা পালিয়ে যান।
এ সম্পর্কে আরো উদাহরণ আছে। বড় উদাহরণ তো আমাদের ঘরেই। এক-এগারোর সরকারের সময় তারেক রহমানকে দুর্নীতি, অর্থপাচার, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা যায়, জেলে বন্দি অবস্থায় কয়েকজন সামরিক অফিসার তাঁকে মেরে হাড়গোর ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর গুরুতর অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য মইন-ফখর সরকার প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে লন্ডনে পাঠায়। তিনি তাঁর অপরাধ স্বীকার করে আর রাজনীতি করবেন না এই মর্মে তৎকালীন সরকারকে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান।
তারপর ১০ বছর হতে চলেছে। তাঁর প্যারোলে মুক্তির মেয়াদ বহু বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। দেশে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপরাধে বিচার চলছে। কোনো কোনো মামলায় তাঁর কারাদণ্ড হয়েছে; কিন্তু আদালত-আইন সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি রাজার হালতে বিদেশে বসবাস করছেন। তাঁর নাকি চিকিৎসা এখনো চলছে; কিন্তু রাস্তাঘাটে বাঙালির দেখা পেলে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন, নইলে তাঁর হাঁটাচলা স্বাভাবিক। তাঁর বন্ধুরা বলেন, তিনি নাইট ক্লাবেও নাচতে যান।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথায় আসি। কারাবাসে আসার আগেই তিনি নানা রোগে ভুগছিলেন। সৌদি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন চিকিৎসার জন্য। সেখানে তাঁর হাঁটুর অপারেশনও হয়েছে। দুই বছরের কারাবাসে তিনি যথেষ্ট উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন। তার পরও কি তাঁর রোগ গুরুতর আকার ধারণ করেছে? আমি বিএনপির গোয়েবলসদের প্রচারণা বিশ্বাস করি না।
তারা আগে বলেছিল, মাঠের আন্দোলন দ্বারা তারা তাদের নেত্রীকে মুক্ত করে আনবে। এমন স্লোগানও দিয়েছিল, ‘জেলের তালা ভাঙব, খালেদা জিয়াকে আনব।’ সেই হুংকারও শোনা যাচ্ছে না। এখন আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার কথা আছে, কাজ নেই। খালেদা জিয়ার দল এবং পরিবারও মানবিক কারণ দর্শিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে, অথবা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ওই মানবিক কারণ দেখিয়ে প্যারোলে মুক্তির আবেদন জানাবে বলে শোনা যাচ্ছে।
কাগজে প্রকাশিত খবরে জেনেছি, আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন চাওয়ার খবরটি পাক্কা; অন্যদিকে খালেদা জিয়ার পরিবার, বিশেষ করে তাঁর বোন মানবিক কারণে বোনের মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। সবই এখন পর্যন্ত মৌখিক। বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে টেলিফোনে এই আবেদন জানিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেও একই আবেদন জানিয়েছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি এই অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের আরো বলেছেন, ‘বিএনপির কাছ থেকে কোনো লিখিত আবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। তবে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক বন্দি নন, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধে আদালতের বিচারে দণ্ডিত ব্যক্তি; তাঁকে জামিন দেওয়া না-দেওয়ার এখতিয়ারও আদালতের।’
খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে মাঠের আন্দোলন মাঠেই মারা গেছে। এখন সেই মুক্তির জন্য তারা মানবিক আবেদন জানানোর পন্থা ধরেছে। আমার ধারণা, এই কৌশল গ্রহণের বড় কারণ দুটি। এক. রাজনৈতিক আন্দোলন যখন ব্যর্থ, তখন নেত্রী গুরুতর অসুস্থ এবং মানবিক কারণে তাঁর অবিলম্বে মুক্তি দরকার—এই প্রচার চালিয়ে সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা, যাতে খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সরকার নির্দয়—এটা সাধারণ মানুষ ভাবে, সে জন্য তাঁকে মুক্তিদানে সরকার বাধ্য হবে।
দ্বিতীয় কারণ, নেত্রীর কারাবাস এবং লন্ডন থেকে অর্বাচীন ‘ওহি’র দ্বারা চালিত হতে গিয়ে বিএনপি আজ ভাঙনের পথে। কর্মীরা নিরাশ ও নিষ্ক্রিয়। বিএনপির হাতে এমন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই, যা দিয়ে কর্মীদের সক্রিয় করে তুলে দলটিকে চাঙ্গা রাখা যায়। সুতরাং খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত অপরাধী জেনেও তাঁর মুক্তির দাবিকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে সরকারের ওপর তারা চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এ ব্যাপারে শুধু বিএনপি নয়, তাদের ব্যান্ডওয়াগনের ডা. জাফরুল্লাহ, ড. কামাল হোসেন পর্যন্ত উচ্চকণ্ঠ।
খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন পেলে উচ্চ আদালত কী করবেন জানি না, তাঁদের কিছু বলার এখতিয়ার আমার নেই; কিন্তু সরকারকে বলব, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হোক। তিনি গুরুতর অসুস্থ না হলে জনসাধারণকে তা জানিয়ে তাদের মন থেকে বিভ্রান্তি দূর করা হোক। আর গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে তাঁর গৃহে নজরবন্দি রেখে আরো উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। সহৃদয় পাঠকরা আমাকে নির্দয় নিষ্ঠুর ভাববেন না, আমিও চাই খালেদা জিয়া রোগমুক্ত হোন এবং দীর্ঘকাল বেঁচে থাকুন। তা না হলে তাঁর শাসনামলের এত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে কে?
- আরও পড়ুন >> এবার ভোট এত কম পড়ল কেন?