অসহায় মেয়েগুলোকে বাঁচান

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

২০১৯ সালটি নারী নির্যাতনের জন্য মাইলফলক তৈরি করেছিল। প্রতিদিন নানা বয়সী নারী-কিশোরী, তরুণী, গৃহবধূ থেকে শিশুকন্যারা লাগাতার ধর্ষণ, কখনো ধর্ষণ শেষে হত্যার শিকার। প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকার খবরগুলো পড়ে ভাবতে হয়, কবে এই সামাজিক নৃশংসতা বন্ধ হবে। অপরিণত দেহের শিশুরাও দুর্বৃত্তদের যৌন লালসা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। কী বিকৃত বাসনার প্রকাশ।

কেন জানি মনে হয়েছিল, ২০২০ সালে মুজিববর্ষে এই পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা হ্রাস পাবে, বন্ধ হবে; কিন্তু না, দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতন পূর্বধারাবাহিকতায় একইভাবে চলছে। কোনো কোনো দিন পূর্ববর্তী সময়কে হার মানাচ্ছে। এ বিষয়ে এর আগে অনেক লেখার পরিণতি দাঁড়িয়েছে অরণ্যে রোদন। মাঝেমধ্যে এ বিষয়ে কারো লেখাও পড়েছি। তবে এই নতুন বছরে ঘটনার তাড়নায়ই বোধ হয় একাধিক কলামিস্ট নারী নির্যাতনের বীভৎস রূপ নিয়ে প্রতিবাদী লেখায় মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

universel cardiac hospital

ফেব্রুয়ারি। মহান একুশের মাস। চারদিকে আদর্শিক বক্তব্য, অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বইমেলা—এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে সমাজবিরোধীদের দুর্বৃত্তপনা একুশের পরিবেশ পরিহাস করতেই যেন শিখর ছুঁতে চাইছে। ফেব্রুয়ারি ১১ (২০২০) একটি দৈনিকে শিউরে উঠার মতো আতঙ্কজনক সংবাদ শিরোনাম : ‘রাজধানীতে এক রাতে চার শিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’।

প্রতিবেদনের বিশদ বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে ঘটনাগুলোর পাশবিক চরিত্র। দরিদ্র পরিবারের ১৩ বছরের মেয়ে বরিশাল থেকে ঢাকায় কাজ খুঁজতে এসে রাস্তায় দুর্বৃত্তদের হাতে আটক এবং ধর্ষণের শিকার—রেহাই পায়নি তার সঙ্গী বান্ধবী। তারা দৃর্বৃত্তদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। এর আগের দিনের খবর ‘কদমতলীতে দুই বান্ধবীকে গণধর্ষণ : গ্রেপ্তার ৩’। এদের ধর্ষণ করা হয়েছে বাসায় ঢুকে এবং ধর্ষকরা ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের। অর্থাৎ বাসায়ও নিরাপদ নয় শিশু কিংবা কিশোরী কিংবা তরুণী, এমনকি গৃহবধূ।

গ্রাম, ছোটখাটো শহর থেকে শুরু করে রাজধানী মহানগরী ঢাকা এবং তার আশপাশ এলাকা—একদা যা ‘শহরতলি’ নামে পরিচিত—এসব স্থানই যেন বিশেষভাবে নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, হয়ে উঠছে যৌন উত্পীড়নের অভয়াশ্রম। সমাজের বিকৃত মানসিকতা বাংলাদেশে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? মনে হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য অবস্থা।

দুই.

কথাটা মনে হয়েছে, দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন নারী নির্যাতনের খবরগুলো পড়ে। সামাজিক শক্তি, শাসনশক্তি কি এখন এতটাই নির্জীব, অসহায় অবস্থায় পৌঁছেছে যে নারীদের জন্য কোনো নিরাপদ স্থান অবশিষ্ট নেই। রাস্তা, রাজপথ, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্র, শিক্ষায়তন, কর্মস্থল, এমনকি নিজ গৃহ। কোথাও তারা নিরাপদ নয়, এমনকি শিশুকন্যা—বয়স তিন-চার-পাঁচ।

এ কোন বাংলাদেশি সমাজ; বিকৃত বাসনার, যৌন লালসার এক অস্বাভাবিক মহোৎসব। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসার ছাত্রী সর্বাধিক আক্রমণের শিকার। নতুন বছরে, মুজিববর্ষে জানুয়ারি থেকেই দৈনিকগুলোতে বেরোতে শুরু হয়েছে বিভিন্ন বয়সী নারী ধর্ষণের খবর—সমাজ নির্বিকার। এগুলোর মধ্যে আমরা শুধু বিশেষ কয়েকটি খবরই তুলে ধরছি, মাসভর প্রতিদিনকার খবর নয়।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, জানুয়ারির শেষ দিনটিতে কুমিল্লায় এক বাস হেলপার বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করেছে। হেলপারকে অবশ্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই দিনের খবর ‘পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে তরুণীকে ধর্ষণ’। ‘আবারও চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ’। ‘ঘাটাইলে তিন স্কুলছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণ’ (২৭-১-২০২০)।

‘মহান একুশের প্রথম দিনেই একুশের মুখে কালো কালির ছাপ। ময়মনসিংহ জেলার ‘ধোবাউড়ায় বিয়ের প্রলোভনে দিনের পর দিন ধর্ষণ’/অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাত করে ফেরত’। শিশুটির বয়স ১৩ বছর। কে এই দুর্বৃত্ত? নাম তার ওয়ালিউল্লাহ।

অন্যদিকে একই সময়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে আবদুস সালাম নামের এক বখাটে যুবক। ধর্ষিতা একজন মাদরাসাছাত্রী।

তবে অভাবিত ঘটনা হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে এক দফা ধর্ষণেও ঘটনার সমাপ্তি হয়নি। সংবাদ শিরোনাম : ‘ভিডিও করতে দ্বিতীয় দফা ধর্ষণ’। ভিডিওর উদ্দেশ্য ৫০ হাজার টাকার পণ দাবি। এসব দুষ্কর্মের হোতা ছাত্রীর বন্ধু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এবং তাঁর সঙ্গীরা। উদ্দেশ্য বিকৃত পন্থায় অর্থ উপার্জন।

তিন.

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষায়তনের পরিবেশও এতটাই দূষিত হয়েছে যে প্রকাশ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, ছাত্রীও বাধ্য হয় এমন জঘন্য কর্মে নিজেকে সমর্পণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এসব ঘটনার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে, তা আমাদের জানা নেই।

কিন্তু সব ঘটনা তো এক ধারার নয়। পূর্বোক্ত ১০ ফেব্রুয়ারির আরেকটি সংবাদ শিরোনাম : ‘প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় স্কুলছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ’। ঘটনাস্থল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ। তরুণের প্রেম এমনই যে তার পরিণাম ধর্ষণ। আসলে এসব প্রেম নয়, প্রেমের নামে যৌন লালসার পরিতৃপ্তি।

পরের দিনের সংবাদটি ভয়ংকর প্রকৃতির। শিরোনাম : ‘ছোট বোনের সামনে বড় বোনকে ধর্ষণ’। অকুস্থল সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা। ধর্ষিতা তৃতীয় শ্রেণির স্কুলছাত্রী, বয়স ৯ বছর। ভাবা যায় ৯ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ! এসব ঘটনার কতটা সুবিচার মেলে তা আমাদের জানা নেই। ঘটনার ফলোআপ কমই দেখা যায়।

একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার শিশু বা তরুণী বা যুবতী দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির। এককথায় নিম্নবর্গীয় পরিবারের সন্তান। ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় ক্রমিক অবস্থানে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, সর্বাধিক ধর্ষণের শিকার পোশাককর্মী—তরুণী বা যুবতী।

প্রাসঙ্গিক একটি সংবাদ : মায়ের চিকিৎসার জন্য ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন এক তরুণী পোশাককর্মী (বয়স ২০)। সেখানে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার ওই তরুণী ঘটনার জটিলতায়—বিশদ বিবরণে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট।

দিনগুলো গত হচ্ছে কিন্তু ধর্ষণের ঘটনার বিরাম নেই, এটাই সামাজিক বীভৎসাচারের প্রতিদিনকার খবর হয়ে চলেছে। আরো একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম : ‘চার শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ’। ঘটনাস্থল টঙ্গী, শ্রীমঙ্গল ও স্বরূপকাঠি। স্কুলছাত্রী কিশোরী ধর্ষণের শিকার। আপাতত শেষ খবরটি : ‘কেশবপুরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ, বাবাকে মারধর’।

বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র ও ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীদের এই যে মানসিক বিকৃতি, প্রধানত যৌন অনাচারে, এর প্রভাব সমাজে মারাত্মক। অনেকের প্রশ্ন : সমাধান কী? কারো মন্তব্য : ‘চরম শাস্তি’, ‘কারো দৃঢ় মত একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই এই ব্যাধির চিকিৎসা।’ প্রশ্ন, দ্রুত সুবিচার, কঠোর শাস্তিই কি নিরাময় পন্থা? নাকি সেই সঙ্গে সমাজ সংস্কার ও দূষণমুক্তির সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক সুশাসন ও নিরপেক্ষ শাসন সমাজকে সুস্থ রাখার লক্ষ্য সামনে রেখে?

এই যে বিকৃত যৌন মানসিকতার একখণ্ড চালচিত্র তুলে ধরা হলো, ‘মহান একুশের’ প্রেক্ষাপটে। এর একটি প্রতীকী স্বরূপ ধরা পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের প্রেক্ষাপট বিচারে। সূত্র উৎস যথারীতি সংবাদপত্রের খবর। শিরোনামটি গুরুত্বপূর্ণ : ‘আগের রাতে চায়ের দোকানে পরিকল্পনা’। সত্যি অবিশ্বাস্য মনে হবে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বাক্যটি : ‘মেয়েটির পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য ঘটনার আগের দিন রাতে পাঁচ বন্ধু মিলে ধর্ষণের পরিকল্পনা করে।’

ভাবা যায় টাকা আদায়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেখানকার বন্ধুস্থানীয় ছাত্রীকে গণধর্ষণের পরিকল্পনা করতে পারেন? পরিস্থিতি বিচারে বলা কঠিন, দেশের আইনি বিচারে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কতটা গুরুত্ব পেতে পারে। সমাজে ধর্ষণব্যাধির মারাত্মক পরিস্থিতিতে এত আটপৌরে ঘটনা। ধর্ষণোত্তর হত্যার সংখ্যাও কম নয়। কম নয় শিশুকন্যা ধর্ষণ ও হত্যা। এই সামাজিক বীভৎসাচার চলতে দেওয়া যেতে পারে না।

অবস্থাদৃষ্টে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না, যদিও শিশু ও নারী নির্যাতনের বিচারে বিশেষ আইন ও ট্রাইব্যুনাল আছে। কিন্তু দরকার সেগুলোতে দ্রুতগতির সচলতা এবং দ্রুত বিচার সম্পাদন। দরকার হতে পারে শাস্তির বিধান সংশোধন চরমপন্থায় : অন্য কোনো উপায়ে এ ব্যাধির নিরাময় ঘটবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একমাত্র আপনিই অসহায় মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারেন তাত্ক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে। আপনি মাদরাসাছাত্রীকে প্রাণে বাঁচাতে পারেননি, ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সুবিচার নিশ্চিত করেছেন। ধর্ষণের ঘটনা না হলেও আপনিই আবরার হত্যারও সুবিচারের পথ নির্দেশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে আপনিই পারেন র‌্যাবসহ চৌকস পুলিশ গ্রুপকে সক্রিয় করে নিয়মিত নারী ধর্ষণ প্রক্রিয়ায় চাপ সৃষ্টি করতে। দরকার ধর্ষক-দুর্বৃত্তদের চরম শাস্তি, দ্রুত বিচারে—হোক তারা শিক্ষার্থী বা সমাজের যেকোনো শ্রেণির মানুষ। আপনি কি অসহায় মেয়েদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন না?

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে