অবশেষে সেই বাংলাদেশিকে পরিবারকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। আগামী মার্চেই তাদের দেশে ফিরতে হবে। দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার জন্য আবেদন করা হলেও ছেলে ‘প্রতিবন্ধী’ অজুহাত দেখিয়ে ওই আবেদন নামঞ্জুর করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল এক প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ছয় বছর বয়সী ওই ছেলেটির নাম আদিয়ান। ২০১১ সালে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে যান আদিয়ানের বাবা ড. মেহেদি হাসান ভূঁইয়া। পরের বছরেই বাংলাদেশে এসে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। ২০১৩ সালে স্ত্রী রেবেকা সুলতানাকেও তিনি দেশটিতে নিয়ে যান। সেখানে গিলং হাসপাতালে আদিয়ানের জন্ম হয়।
আদিয়ানের জন্মের কয়েক মাস পরেই তার পরিবার লক্ষ্য করে, সে সহজে মাথা তুলতে পারছে না। সম্ভবত জন্মের কিছু সময় আগে বা পরে স্ট্রোকের কারণে সে হালকা সেরিব্রাল প্যালসিতে আক্রান্ত হয়। এই কারণে ২০১৫ সালে দেশটির কর্তৃপক্ষ তাদের সেখানে বসবাসের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভাষ্য, অস্ট্রেলিয়ায় থাকার জন্য স্বাস্থ্যগত বিষয়ে যেসব শর্ত পূরণ জরুরি তা পূরণে তাদের ছেলে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে আদিয়ানের বাবার দাবি, তার শারীরিক দুর্বলতা আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। সে এখন স্বাভাবিক শিশুদের মতোই আচরণ করছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি ডিগ্রিসহ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন মেহেদি হাসান ভূঁইয়া। এরপর ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্য সরকার কর্তৃক দক্ষ অভিবাসী হিসেবে স্থায়ী ভিসা পান। যার মাধ্যমে পরিবারসহ তিনি অস্ট্রেলিয়া আজীবন থাকার নিশ্চয়তা পান।
কিন্তু আদিয়ানের শারীরিক অক্ষমতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রক্রিয়ায় পুরো পরিবার দেশটিতে বসবাসের যোগ্যতা হারায়। অস্ট্রেলিয়ার কঠোর অভিবাসী নীতির ‘ওয়ান ফেলস অল ফেল’ অনুযায়ী একজনের কারণে পরিবার সব সদস্যকে দেশটি থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভূঁইয়া পরিবার আপিল করে। তবে সেই আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল ট্রাইব্যুনাল।
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের অনুমতি চেয়ে করা ভূঁইয়া দম্পতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আবেদন খারিজ করে দিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছেন, ছেলেটির শারীরিক যে অবস্থা তাতে তাকে নিরবচ্ছিন্ন থেরাপি সহায়তা দিয়ে যেতে হবে। আর এটি দেশের স্বাস্থ্য কাঠামোর জন্য একটি ‘বোঝা স্বরূপ’।
আদিয়ানের বাবা জানিয়েছেন, ফিজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে সে দিন দিন উন্নতি করছে। সে এখন অনেক ভালো আছে। পড়াশোনাতেও কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। সে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে, সবকিছু শিখছে, বাসায় শিশুতোষ ভিডিও দেখছে। মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে পারে।
এ ঘটনায় আদিয়ানের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় অস্ট্রেলিয়ার গার্ডিয়ান প্রতিনিধি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আদিয়ান বেশ সরব। সে ফুটবল খেলতে ভালোবাসে এবং সে তার শারীরিক অক্ষমতাকে বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করছে।
আদিয়ানের চিকিৎসা-সংক্রান্ত আড়াই বছরের (২০১৬-২০১৯) কাগজপত্র পর্যালোচনা করে আপিল ট্রাইব্যুনাল। পরে তারা তাদের সিদ্ধান্তে জানায়, আদিয়ানের কিছু শারীরিক দুর্বলতা রয়েছে এবং স্থায়ী প্রকৃতির। এজন্য তার বিশেষ ধরনের সেবা প্রয়োজন, এমনকি স্কুলেও। তাই অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারটি অবদান রাখলেও অভিবাসী নীতির কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের।
তবে আপিল ট্রাইব্যুনালের এই যুক্ত মানতে নারাজ বাবা মেহেদী হাসান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আমার কিছুতেই মাথায় আসছে না যে, একটা ছেলের বাম হাতে সামান্য দুর্বলতা আছে। কিন্তু তার জন্য বিশেষ শিক্ষা কেন দরকার হবে? কিন্তু আমি যতদূর জানি, বিশেষ শিক্ষা তো কেবল তাদেরই দরকার হয় যারা মূল ধারার স্কুলে যেতে পারে না।’
তবে এখানেই দমে যাননি আদিয়ানের পরিবার। অস্ট্রেলিয়া থাকার শেষ সুযোগ হিসেবে তারা দেশটির অভিবাসন মন্ত্রী ডেভিড কোলম্যানের কাছে আপিল করেছেন। তবে এখানেও তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কারণ এক্ষেত্রে মন্ত্রী তার ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য নন।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক দৈনিক গিলং অ্যাডভাইজারকে মেহেদী হাসান ভূঁইয়া বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের অস্ট্রেলিয়া ছাড়তে হয় কি না, এই চিন্তায় কোনো কাজে মন দিতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমরা যেন নরকে রয়েছি।’
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূঁইয়া পরিবারকে আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত থাকার অনুমতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। এ সময়ের মধ্যে তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত না গেলে তাদের দেশ ছাড়তেই হচ্ছে।