প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া আব্দুল হাদী ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে তার টাকার ব্যাগটি খুঁজে না পেয়ে। তাকে বলা হলো ‘তুমি ভয় পাচ্ছো কেন! খুঁজলেই পেয়ে যাবে ব্যাগটি।’ এ কথা শুনে ও বলল, ‘মা ব্যাগ না পেলে মারবে।’ একটু পর ব্যাগটি খুঁজে পেয়ে হাদীর চোখে-মুখে স্বস্তির ছাপ।
ঘটনা দুই: দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে তার বাবা ধমক দিয়ে বলছেন, এখনো পড়তে বসছো না কেন? এ কথা শুনে ছেলে উমায়ের বলল, ‘বাবা তুমি আমাকে ধমক দিলে কেন! আমি এখন পড়ব না।’ এরপর বাবা যখন সুন্দরভাবে বলল তখন পড়তে বসল উমায়ের।
ঘটনা তিন: দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া হাসিবুল (ছদ্মনাম) হাঁটুতে বাথা পেয়েছে। এতে তার হাঁটুর ওপরে চামড়া কিছুটা ছড়ে গেছে। কিন্তু ভয়ে তার মাকে এ কথা জানায়নি সে। কারণ মা জানতে পারলে মারবে তাকে।
উমায়ের, হাদী, হাসিবুলের মতো এমন অনেক শিশুই অভিভাবকদের কাছ থেকে এমন আচরণের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের আচরণকে শিশুর প্রতি সহিংসতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের করা ‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯’ প্রতিবেদনে।
তাতে বলা হয়েছে, ১৫ বছরের নিচে প্রতি ১০ জন শিশুর নয়জনই তাদের অভিভাবক বা সেবা প্রদানকারীদের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে সহিংস শাসনের শিকার। বিশেষ করে বাবা-মায়ের কাছেই বেশি এ সহিংসতার শিকার হয় তারা।
সহিংসতা বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে বাচ্চাকে মারা, ধমক দেয়া বা অন্য কোনো শাস্তি দেয়া।
১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ তাদের লালন-পালনকারী বা বাবা-মায়ের কাছ থেকে সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছে। সন্তানদের স্বার্থে তারা এমন আচরণ করছেন বলে দাবি ওই সব লালন-পালনকারীদের।
‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯’ জরিপে সন্তানের সঙ্গে আচরণসংক্রান্ত প্রশ্নে ৬৪টি জেলার ৬১ হাজার ২৪১টি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া উত্তর থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সূচকের অবস্থান তুলে ধরা হয়।
এই জরিপের প্রসঙ্গে আলাপকালে এক বেসরকারি চারকরিজীবী বলেন, তার চার বছরের ছেলে একদিন ১৩ সংখ্যাটি লেখার সময় ১ লিখেছে ছোট আর ৩ লিখেছে বড়। এ জন্য তার স্ত্রী ছেলেকে মারতে তেড়ে আসেন। এ সময় ভয়ে কাঁপছিল ছেলেটি। এ ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে স্ত্রীকে বোঝান তিনি।
শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত এবং নেতিবাচক আচরণের প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমজকল্যাণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অধ্যপক ড. শাহানা নসরীন বলেন, বাচ্চাদের সঙ্গে সহিংস আচরণ করা নিষেধও বলতে পারেন। বাচ্চাদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা যখন সহিংস আচরণ করে, এটা তার মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। বড় হয়ে সেও এভাবে সহিংস আচরণ করে।
সন্তানের সঙ্গে জবরদস্তি আচরণের পেছনে তাদের ওপর পরিবারের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যাওয়াকে অনেকটা দায়ী করেন সমাজ গবেষক অধ্যাপক শাহানা। তিনি বলেন, সবাই চায় তার সন্তান ফার্স্ট হবে। সবার সেরা হবে। এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। পরিবারই ঠিক করে দেয় তার সন্তান বড় হয়ে কী হবে। সেটা পূরণ করার ক্ষমতা সন্তানের আছে কি না সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ওমুক পারলে তুমি পারবে না কেন- এভাবে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক না।
বাবা-মাকে তার সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ড. শাহানা নসরীন বলেন, সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব শৈশব। এ সময় বাচ্চাদের সঙ্গে শিশুসুলভ আচরণের মাধ্যমে তার সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বাচ্চাদের পছন্দ ও তার মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। একটা জামা দিয়ে মা তার সন্তানকে সেটি পরে নিতে বললেন। কিন্তু তিনটি জামার মধ্য থেকে এটি পছন্দ করতে বললে বাচ্চার ইচ্ছের মূল্যায়ন হতো।
অন্যান্য সূচক
দেশে শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণ বাড়লেও তাদের অপুষ্টির হার কমেছে বলে তথ্য এসেছে মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভেতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শিশু অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
স্কুলে শিশুদের উপস্থিতির হারও বেড়েছে। তিন থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শৈশবকালীন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তুলনামূলক কম। এ সংখ্যা গড়ে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ সালে যা ছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এ সময়ে স্কুলে উপস্থিতির হার কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৯ ভাগ। এখনো ১৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। স্কুলে যাওয়ার শিশুদের তুলনায় এ হার বেশি। শিক্ষা শেষ না করে ঝরে পড়ার হারে প্রতি ৫ জনের ১ জনই ছেলে।
- আরও পড়ুন >> চট্টগ্রামে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ডা. শাহাদাত
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু একবার হলেও মায়ের দুধ পান করেছে। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এমন শিশুর সংখ্যা অনেক কম মাত্র ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস ভবনে আয়োজি অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিবিএসের অতিরিক্ত সচিব শহিদুল ইসলাম ও ইউনিসেফের অফিসার ইনচার্জ অ্যালেন বালাডিন ডমসন।