সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে বা যাবে এ ধারণা প্রায় চৈতন্যর সমান বয়সী। মানুষতো বটেই অন্য কোনো প্রাণীও এ ধারণা পোষণ করে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।
যেহেতু একেক প্রাণীর সামনে অন্য আরেক প্রাণী হরহামেশা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাদের মেমোরিতে এটা অটোমেটিক একটা রেখা তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়।
যেহেতু প্রাণী হিসেবে মানুষ জেনেছে ও দেখেছে যে, দুনিয়াতে জন্মানো সবকিছু একটা সময় জন্ম নেয় আবার আরেকটা সময় শেষ হয়ে যায়। মানে জন্ম ও মৃত্যু।
এ মৃত্যু আদতেও মৃত্যু কিনা সে বিষয়ে তর্ক হতে পারে। সেটা ধর্মীয় পুনর্জীবন বা অ্যাবিলিউশন থিউরি দুটোর ক্ষেত্রেই সত্য। জন্মানো এবং চলে যাওয়া এ দুটোই তলে তলে তার অস্তিত্বে গুঞ্জন করে প্রায় নিজের অজান্তেই তাকে তটস্থ রাখে।
এটাই তার শূন্যতা, এটাই তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কারণ মানুষের ইতিহাস শুরু হওয়ার পর থেকে সে দেখতে পেয়েছে কত রকম কারণে পরস্পরকে হত্যা করছে মানুষ।
জগতে প্রায় সব সম্পর্কগুলোই গড়ে ওঠে স্বার্থকেন্দ্রিক। স্বার্থহীন সম্পর্ক অসম্ভব। যেমন সন্তান জন্মদান। এইটা বেসিক স্বার্থ। কারণ সে তার জিন বা তার উত্তরাধিকারের ভেতর দিয়ে জগতে বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ তার জিনকে নিজের মতোই ভালোবাসে, রক্ষণাবেক্ষণ করে।
মাঝে মাঝে নিজের চেয়েও সে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসে। তার পার্টনারকে সে ভালোবাসে তার জিনকে পয়দা করার জন্য। এই যে মানুষ ভালোবাসে, প্রেম করে, ফুল দিয়ে প্রিয়জনকে জীবনসঙ্গী হওয়ার জন্য অফার করে কেন?
প্রেমে পড়া বিষয়টা আপাত নিরীহ মনে হলেও আদতে তা নয়। প্রেম পরস্পরের সম্পর্ক তৈরি করার এক ধরনের কৌশল। প্রথম দিকে প্রেমে মত্ত হয়েছে, কিছুদিন পর বিয়ে হয়েছে, সন্তান পয়দা হয়েছে বা হয়নি এরকম বহু সম্পর্ক ভেঙে গেছে বা খারাপ পরিণতি আমরা প্রায়শই দেখতে পাই।
একটা ছেলে একটা মেয়েকে যখন ভালোবাসে, উন্মত্ত হয় তার জন্য সে নিজেই হয়তো জানে না সে আসলে মেয়েটাকে তার জিন ট্রান্সফারের জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ ভাবে।
ছেলেটা ভাবে যে এই মেয়েটি তার জিনকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। আবার শুধু ছেলেটা চাইলেই তো হল না, মেয়েটি তখন ছেলেটির ভেতর দেখে যে, এ তার জিনকে ঠিকমতো খাওয়াতে, পরাতে পারবে কিনা, নিরাপত্তা দিতে পারবে কিনা। অধিকাংশ মেয়েদের ক্ষেত্রেই শোনা যায় তারা প্রেম করে বেকার ছেলেদের সঙ্গে কিন্তু বিয়ে করে ধনী বা সচ্ছল ছেলেদের। কেন? কারণ যখন সে আসলেই বাধা পড়তে যাচ্ছে তখন তার জিনের নিরাপত্তার প্রশ্ন সবার আগে।
কোনো সংসারে যদি কোনো মা তার সন্তানকে ঠিকমতো লালন-পালন না করে বা কোনো বাবা যদি কোনো সংসারে ঠিকমতো ভরণপোষণ না দেয় তাহলে আস্তে আস্তে সে সংসার ভেঙে পড়তে বাধ্য। কারণ সংসার টিকে থাকেই এ শর্তের ওপর। এটা বিগ ডিল। এ সম্পর্ককে প্রত্যেক মানুষই ভয় পায়।
কারণ সম্পর্কের ভারসাম্য বহন করা এত সহজ নয়। সম্পর্কগুলো বলতে গেলে নেটওয়ার্ক। এ নেটওয়ার্কের বিস্তার খুবই সূক্ষ্ম ও জটিল তারের জটাজাল। যা একজন মানুষকে স্বাধীন হতে দেয় না।
তাকে দায়িত্ববান করে তোলে, এটাকে আমরা হয়তো মহান বন্দিত্ব বলতে পারি। মানুষ সম্পর্ক ও নিঃসঙ্গতা দুটোকেই ভয় পায়। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে সে সম্পর্কের জাল বিস্তার করে। এরপর সে সংসার বা তার নেটওয়ার্ক থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে।
যা তাকে সারা জীবনই বহন করে যেতে হয় অথচ সারা জীবনই সে এর থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু এটা ভেবে সে সব সময় আনন্দ পায় যে, আর বেশি দিন না সব শেষ হয়ে যাবে।
কিছুই থাকবে না; এ কষ্ট আমাকে আর বহন করতে হবে না। সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখার এ ভারবাহী পদ্ধতি থেকে সে আসলে মুক্তি চায়। এ থেকেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার ধারণা তার ভেতর পোক্ত হতে থাকে।
ধরা যাক, প্রাচীন সমাজে অন্যান্য বৃহৎ ক্ষিপ্র ভয়ংকর প্রাণীদের সঙ্গে মানুষকে যখন জঙ্গলে থাকতে হতো বা সামন্তীয় যুগে সামন্তদের প্রজাদাস হিসেবে যখন তাকে থাকতে হতো, আফ্রিকা থেকে যখন তাকে জাহাজ বোঝাই করে ইউরো-আফ্রিকায় দাস হিসেবে চালান করে দেয়া হল। যখন এ দাসের জীবন তাকে সহ্য করতে হতো।
বর্তমানেও বন্দিত্বের ফর্মেট হয়তো আলাদা যেমন আজকের যেই অফিস সংস্কৃতি। সে দাসমালিক, সে সামন্ত জমিদার, সে সামন্ত শাসক আজ অফিসের মালিক হিসেবে দণ্ডায়মান। কৃতদাস, গার্মেন্ট কর্মী আর আট-দশ ঘণ্টা অফিস করা অফিসারদের মধ্যে কী খুব একটা ফারাক আছে? তাদের নিজেদের জন্য কী কোনো জীবন আছে?
তাদের উত্তরাধিকাররা ভালো থাকবে এ ধারণা থেকে সে নিজের সমস্ত সময় বিক্রি করে দেয় অফিস মালিকের কাছে। এরকম আরও অজস্র বন্দিত্বের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এ ধারণা ছাড়া সে বাঁচতে পারে না।
সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এটাই তার বাসনা, ডিজায়ার। এবং এ বাসনা পোক্ত হয়েছে দিনের পর দিন তার ডিএনের সংকেতলিপিতে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এটা আসলে যুগপৎ আনন্দ আর ভয় নির্দেশ করে।
কিন্তু আসলে অদ্ভুতভাবে সবকিছু টিকে থাকে। সে যা যা ভয় পেত সে সবের ফর্মেট বদলে যায়। কিন্তু সবকিছু শেষ হয় না কখনোই। মানুষের আগ্রাসী স্বভাব, মানুষের আত্মরক্ষার স্বভাব, মানুষের প্রতারণার স্বভাব, মুনাফা করার স্বভাব রয়ে যায় তার সেলফিশ জিনে।
সবকিছুর শেষ দেখা অথবা নিজের শেষ দেখা দুটোই দুইদিক থেকে একই ব্যাপার প্রায়। হয়তো সবকিছু শেষ হয়ে গেল আমি বেঁচে আছি। অথবা সবকিছু আছে আমি নেই এ দু’ধরনের চিন্তার প্রবাহ লক্ষ করা যায়।
এটাও তার সেলফিশ জিনের সংকেতলিপি। যেমন আমরা অনুমান করতে পারি মানুষ জানে যে কোনো ড্রাগ তার ক্ষতি করে। এটা জেনেও অজস মানুষ সেই ড্রাগ নিচ্ছে, বহু রকমের ড্রাগ। আর কিছু মানুষ সেই ড্রাগ ছড়াচ্ছে। দেখা যাবে মানুষ কোনো না কোনো ধ্বংসাত্মক নেশায় আসক্ত। সেটা হচ্ছে নিজেকে শেষ করে দেয়ার বাসনা।
কিন্তু সে হয়তো শেষ হয় কিন্তু অনেক হ্যাপা দিয়ে যায় তার আশপাশের মানুষদের। বহু ধর্মগ্রন্থে আছে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার ধারণা। কোনো কোনো গ্রন্থে তারিখ পর্যন্ত উল্লেখ আছে।
দুনিয়ার মানুষ বহুবার বহু ঘটনায় মনে করেছে এইবার বুঝি দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আসলে সেটা টিকে আছে অজস্র প্রাকৃতিক দুর্যোগে, মানুষের সৃষ্টি অজস্র দুর্যোগে, বহু জাতি হত্যায়, পারমাণবিক বিস্ফোরণেও টিকে আছে পৃথিবী ও জীবন। হয়তো এটা কখনোই শেষ হবে না কিন্তু শেষ হওয়ার বহুরকম পদ্ধতি মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবছে ও তা প্রকাশ করছে।
কারণ সে তার বাসনার কারণেই চায় দুনিয়াটা এইভাবে শেষ হয়ে যাক। আমি বলছি না মানুষ যা করছে তা পৃথিবীর জন্য ভালো। সে যে পাহাড় কেটে ফেলছে, সে যে জ্বালানি শেষ করে ফেলছে। সে বনবাদাড় উজাড় করছে।
বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে তুলে জমাট বরফ গলিয়ে সমুদ্রের উচ্চতা সমতলের উচ্চতার চেয়ে বাড়িয়ে তুলছে, এ সব পৃথিবীর জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। কিন্তু পৃথিবীতে মহৎ পরামর্শক কম ছিলেন না যারা মানুষকে এ সব থেকে বিরত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে প্রচুর বই লিখেছেন।
নিজেকে নিজের সর্বনাশা শক্তিকে কন্ট্রোল করার জন্য নানা কসরত শিখিয়েছেন তাদের। শেষে ব্যর্থ হয়ে বলেছেন মানুষের কী কোনো ভবিষ্যৎ আছে? নানা ধরনের ক্রমপ্রসারমান পরিস্থিতির কারণে মানুষের ডিএনেতে নানাভাবে পরিবর্তন এসেছে কিন্তু তবুও বলা যায় সমস্ত নৃশংসতা, হত্যা, দখল, মুনাফা শেষমেষ ক্যাপিটালিজম যা এক দানবীয় স্বার্থপরতা হয়ে গ্রাস করছে সবকিছুকে সেটা কেন টিকে আছে?
জীববিজ্ঞানীরা হয়তো বলবেন সেলফিশ জিন। মানুষ নিজে বাঁচতে চায়, নিজে সুখী হতে চায়, তাকে যারা পয়দা করেছে বা সে যাদের পয়দা করেছে।
যারা পরস্পরের কথাবার্তা বুঝতে পারে এভাবে শুরু হয়েছে ভাষা ও জাতীয়তাবাদ। অন্যভাষা ও অন্য জাতীয়তাবাদকে সে মনে করেছে অপর। তার সুখের ভাগীদার। তার দিকে তাক করে আছে তার মারণাস্ত্র।
এভাবে দুনিয়ার প্রত্যেক জাতি অন্য জাতির দিকে তাক করে আছে তাদের ভয়ঙ্করতম অস্ত্রটি।
হয়তো একদিন তারা নিজেরা নিজেদের শেষ করে দেবে। হয়তো পৃথিবী টিকে থাকবে নতুন কোনো প্রজাতির অপেক্ষায়।