শুক্রবার রাত সাতটার দিকে রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকার বিপরীতে মাঝপদ্মায় বর-কনেবাহী দুই নৌকাডুবির ঘটনায় আজ শনিবার বিকাল পর্যন্ত নদী থেকে ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বর জীবিত অবস্থায় বর উদ্ধার হলেও কনেসহ তিনজন এখনো নিখোঁজ। তাদের জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনরা। স্বজন হারানোর এই শোকে উবে গেছে বিয়েবাড়ির আনন্দ। বাড়িতে এখন শুধুই শোকের মাতম।
মাস দেড়েক আগে বিয়ে হয়েছিল নবম শ্রেণির ছাত্রী সুইটি খাতুন পূর্ণিমার (১৬)। তখন অনুষ্ঠান করা হয়নি। বৃহস্পতিবার কনের বাড়িতে ধুমধাম করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া কনেকে। সেদিন বরপক্ষের লোকজন কনেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের বাড়ি। পরদিন শুক্রবার বরের বাড়িতে হয় বৌ-ভাত। প্রথা অনুযায়ী বর-কনেকে আনতে গিয়েছিলেন কনেপক্ষের স্বজনরা। ফেরার পথে দুটি নৌকা ডুবে যায়।
কনে পূর্ণিমার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙেরহাট গ্রামে। তার বাবার নাম শাহিন আলী। আর বর আসাদুজ্জামান রুমন (২৬) পদ্মা নদীর ওপারে একই উপজেলার চরখিদিরপুর গ্রামের ইনসার আলীর ছেলে। রুমন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। নগরীর নিমতলা এলাকায় তাদের বাড়ি আছে। এ বাড়িতে রুমন একাই থাকেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন চরে।
নৌকাডুবির ঘটনায় যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তারা হলেন- কনে পূর্ণিমার দুলাভাই রতন আলী (৩০), তার মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৬), কনের চাচা শামীম হোসেন (৩৫), স্ত্রী মনি খাতুন (৩০), তাদের মেয়ে রশ্নি খাতুন (৭) এবং তাদের আত্মীয় এখলাস হোসেন। এখলাসের বাড়ি নগরীর কাঁঠালবাড়িয়া এলাকায়।
ঘটনার পরই মা বৃষ্টি খাতুনের সঙ্গে মরিয়মকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর শুক্রবার সকালে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় নদীতে মনি খাতুনের লাশ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া নৌকাডুবির স্থানেই রতন, শামীম এবং তার মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বিকালে তাদের লাশ উদ্ধার করে। সেখানে একটি নৌকাও পাওয়া যায়।
উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্যমতে, নৌকার পাশে পানির নিচে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ছিলেন শামীম। আর তার স্ত্রী মনি খাতুন ১২ বছরের ছেলে আলভিকে উদ্ধার করলেও নিজে বাঁচতে পারেননি।
এখনো যারা নিখোঁজ তারা হলেন- কনে পূর্ণিমা, তার ফুফাতো বোন রুবাইয়া খাতুন (১৩) এবং খালা আখি খাতুন (২৫)। তাদের উদ্ধারে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। আজ সকালে উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পাঁচ সদস্যের একটি দল এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।
একটি নৌকায় ছিলেন পূর্ণিমার মামাতো বোন তারিকা খাতুন (১৮)। তিনি জানান, পদ্মায় দুটি নৌকার মাঝের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। তাদের নৌকায় বর-কনেসহ অন্তত ২৮ জন ছিলেন। নদীতে প্রচণ্ড বাতাস ছিল। আকাশে ছিল কালো মেঘ। হঠাৎ নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে। তখন পুরুষেরা নৌকা থেকে নেমে নৌকা ধরেই নদীতে সাঁতার কাটছিলেন। তারা ভেবেছিলেন নৌকা থেকে নেমে গেলে নৌকাটি ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু ৭-৮ জন পুরুষ নৌকার চারপাশ ধরে সাঁতার কাটার সময়ই নৌকাটি ডুবে যায়। এরই মধ্যে একটি বালু বহনকারী ট্রলার সেদিকে এগিয়ে যায়। যারা সাঁতার কাটছিলেন তাদের রশি দিয়ে টেনে ট্রলারে তোলা হয়।
তারিকা জানান, তাদের নৌকায় কনের বাবাও ছিলেন। ডুবে যাওয়ার সময় কনে পূর্ণিমা তার চাচি মনি খাতুনের পা ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। মনি খাতুন ছেলে আলভিকে ট্রলারে তুলে দিতে পারলেও নিজে উঠতে পারেননি। সকালে তার লাশ পাওয়া যোয়। স্বামী শামীম এবং মেয়ে রশ্নির লাশ পাওয়া যায় একসাথে। ডুবে যাওয়ার আগে কনের বাবা শাহিন আলী তার মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নৌকার ইঞ্জিনের ফ্যানে তার পা কেটে যায়। ফলে তিনিও মেয়েকে তুলে আনতে পারেননি। ট্রলারের লোকজন শাহিনকে উদ্ধার করেন। মেয়ে ভেসে যায়।
পেছনের আরেকটি নৌকায় ছিলেন কনের মামা মাসুদ রানা (৩৫)। তিনি জানান, তাদের নৌকায় ২২-২৩ জন ছিলেন। মাঝপদ্মায় তাদের নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ নৌকার তলা ফেটে পানি উঠতে শুরু করে। তারাও ডুবতে শুরু করেন। ওই সময় সামান্য দূরে থাকা একটি ছোট নৌকা তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সাঁতার কাটতে কাটতে তারা নৌকাটিতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু দুজন উঠতে পারেননি। পরে এ নৌকাটি তাদের তীরে পৌঁছে দেয়। আর বালুর ট্রলারটি সবাইকে নামায় বসড়ি এলাকায়।
বসড়িতে নেমেছিলেন কনের দাদা আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বসড়িতে নামার পর স্থানীয় লোকজন কাপড় দেন। গরম কম্বল দেন। সেগুলো জড়িয়ে আমরা বাড়ি আসি। তখনো জানতাম না যে পেছনের নৌকাটিও ডুবে গেছে। বাড়ি এসে শুনছি সেটিও ডুবে গেছে। ওই নৌকায় থাকা আঁখি এবং শিশু রুবাইয়া নিখোঁজ রয়েছে।
শনিবার সকালে ডাঙেরহাট গিয়ে দেখা গেছে, পুরো গ্রামেই শোকের ছায়া। কনে পূর্ণিমার বাড়ির দিকে মানুষের ঢল। এসেছেন আত্মীয়-স্বজনরাও। নদীতে কারও লাশ পাওয়া গেছে কি না তা ফোন করে একটু পর পর জানার চেষ্টা করছেন। একটু পর পরই উঠছে কান্নার রোল। বাড়িতে পূর্ণিমার মা ছিলেন না। তিনি স্বামীর কাছে হাসপাতালে।
কিছুটা দূরেই পূর্ণিমার দাদাবাড়ি। এ বাড়ির শামিম ও তার মেয়ে এখনো নিখোঁজ। শামিমের স্ত্রীর লাশ পাওয়া গেছে। তাদের বাড়ির সামনেও অনেক মানুষের ভিড়। ভেতরে কান্নাকাটি করছেন নারীরা। উদ্ধার কাজ দেখতে রাজশাহী নগরীর পদ্মারপাড় জুড়েও ভিড় করছেন অসংখ্য উৎসুক মানুষ এবং স্বজনরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী সদর স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, নৌকা ডুবে যাওয়ার পর যারা উদ্ধার হয়েছেন তারা নিজেদের মতো করে বাড়ি চলে যান। কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হন। এখনো যারা নিখোঁজ আছেন তাদের সন্ধানে নদীতে অভিযান চলছে।
- মুজিববর্ষে কেউ ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না: শেখ হাসিনা
- খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে কোনো বর্ষই সফল হবে না: ফখরুল
এদিকে দুটি নৌকাডুবির ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলামকে আহ্বায়ক করে শুক্রবার জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এই কমিটি করে দিয়েছে। দুই কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটিতে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিআইডব্লিউটিএ এবং পুলিশ নৌ-পুলিশ থেকে একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন কমিটির সদস্যরা।
জেলা প্রশাসক হামিদুল হক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এখন নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে মরদেহ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা হচ্ছে।