‘সাত মার্চ ঊনিশশত একাত্তর’ ইতিহাসের আলোকে

র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এম.পি

র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি
র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাসমূহের একটি হচ্ছে ১৯৭১ সনের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সুবিশাল জনসমাবেশে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভিভাষণ। নানা কারণে এই ভাষণটি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে গেছে। পাকিস্তানের ২৫ বছরে বাংলাদেশের বঞ্চনা আর অধিকার হরণের কাহিনী তিনি অতি সংক্ষেপে নিঃখুতভাবে তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায়। আর স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরের পথ নির্দেশ দিয়ে একটি জাতির ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে পাকিস্তানের গর্ভ থেকে কিভাবে একটি সংগ্রামশীল জাতি নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম আবাসভূমি, তথা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে অগ্রসর হবে তার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছিল তাঁর ঐ অভিভাষণ।

বাংলার বঞ্চনার কথা তিনি তুলেধরেছিলেন আর বাংলার মানুষের উপর অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ তিনি আরও বললেন, ‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল’ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন……..।’

বাংলা ও বাংলার মানুষের এই ইতিহাস বর্ণনার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ এর নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাক্রম জনতার সামনে তুলে ধরেন। অতঃপর আমাদের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিব চলমান আন্দোলন ও সংগ্রামের কৌশল তুলে ধরেন। তিনি বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই্ যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফইজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সে গুলোর হরতাল কাল থেকে……, রিকসা, ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গর্ভনমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ তিনি বললেন, ‘এরপরে যদি বেতন না দেওয়া হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে দিক নির্দেশনা দিলেন সংগ্রামশীল মানুষের করণীয় সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ আসন্ন যুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আরও বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’ (‘এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, তোমরা বন্ধ করে দেবে’)। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো’ (অর্থাৎ সেনানিবাসসমূহের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিতে হবে)। দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি প্রত্যয় দৃঢ় ঘোষণা দিলেন’…………আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের মারতে পারবে না।’

একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ কৌশল তিনি সেদিন জাতির সামনে উপ¯’াপন করেছিলেন। তিনি, বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় অভ্যস্ত এক সংগ্রামী নেতা, সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যাঁর অভিজ্ঞতা বই পুস্তক পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং  যিনি বিশ্বাসে ও কর্মপন্থায় একজন গণতান্ত্রিক মানুষ, হঠাৎ করে এই বাস্তবতার সম্মুখীন হলেন যে, দেশকে শত্রু মুক্ত করতে হলে সশস্ত্রতার কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি গেরিলা যুদ্ধেরও রূপরেখা দিলেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘………..আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার দেশের মুক্তি না হয়, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হল, কেউ দেবে না।’ তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘ কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।’ ‘যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’

সবশেষে তিনি, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ‘রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে, গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে’ ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই হাজার বছরের শৃংখল মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হল। ৭ মার্চের অভিভাষণের ঐতিহাসিকতা এখানেই। একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র যুদ্ধে রূপান্তর হল এবং বাঙালিরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করল এই যুদ্ধের মাধ্যমে। ইতিহাসে তাই এই ৭ মার্চ এক অনন্য ভূমিকায় অনাদিকাল পর্যন্ত ভাষ্মর হয়ে থাকবে।  

লেখক: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মী,

সম্পাদক, মত ও পথ (পাক্ষিক ও অনলাইন দৈনিক)

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে