বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল

সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

বর্তমান বিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক অবস্থা, একই সঙ্গে রাজনীতি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন—সব বিষয়ই কিন্তু আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জের বাইরে আছে, এমন নয়। বাংলাদেশ নানাভাবে মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে আরো এগিয়ে যাওয়ার জন্য আশাবাদ ব্যক্ত করছি এবং সেভাবে আমরা কাজ করছি। কিন্তু কতগুলো সমস্যা আমাদের সামনে এসেছে। এর মধ্যে কিছু সমস্যা ছিল অভ্যন্তরীণ এবং এর সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো আন্তর্জাতিক সমস্যা যোগ হয়েছে। এখন এই সমস্যাগুলো যদি আমরা অতিদ্রুত উপলব্ধি না করি এবং সমাধানের চেষ্টা করা না হয়, তাহলে কিন্তু সামনে এগোতে পারব না। এগোতে যেমন পারব না, তেমনি অসুবিধাও হবে।

প্রথমে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বলি। আমাদের যে উন্নয়নের নীতি ও কৌশল আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের কতগুলো ব্যাপার আছে। আমাদের যে বড় এবং মেগা প্রকল্পগুলো আছে এবং অন্যান্য প্রকল্প, যেগুলো জনসাধারণের কল্যাণের জন্য করা হচ্ছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর বেশির ভাগই কিন্তু সময়মতো শেষ হতে পারছে না। নতুন সরকারের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে; কিন্তু আমরা এডিপি প্রকল্পগুলো ঠিকমতো করতে পারছি না। এর কতগুলো কারণ ও অভিজ্ঞতার ব্যাপার আছে। আমাদের কর্মদক্ষতার ব্যাপার আছে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন খুব একটা হয়নি। তথাকথিত উন্নয়ন হয়েছে বা আগের মতোই আছে। অনিয়ম ও সময়ক্ষেপণ যেমন আছে, দুর্নীতিও আছে। ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি কিন্তু এখনো চলমান।

ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়ীরা যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছে, তা কিন্তু নয়। নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা আছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ঘাটতিগুলো চোখে পড়বে। কিছু বিষয় আছে, যেগুলো অন্যান্য দেশে হয়তো দুই মাস লাগে। আমাদের এখানে ওই একই কাজে দুই বছর লেগে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো প্রকটভাবে বোঝা যায়। এ ছাড়া দুর্নীতি তো আছেই।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে গেছেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। সেই ব্যক্তি যে বিখ্যাত এবং বিরাট শিল্পপতি, তা-ও নন। ইদানীং তাঁর নাম পত্রপত্রিকা ও টিভিতে এসেছে। তিনি কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছেন, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হয়েছেন। তাঁর পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে ছিল। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যাঁরা চালান, তাঁরা তাঁকে দেখেছেন। এর মধ্যেও তিনি টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তিনি টাকা নিয়ে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন।

এর দ্বারা কী বোঝায়? তার মানে প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছিল এবং কিছু ব্যক্তিরও সহযোগিতা থাকতে পারে। তা না হলে তো এত বড় কাণ্ড ঘটতে পারে না। এতগুলো টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল—ভাবা যায়? এসব যদি চলতে থাকে, তাহলে কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

এখন সময় এসেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো, সৎ, যোগ্য ও পরীক্ষিত লোকদের নিয়োগ দেওয়া। তাদের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে এগিয়ে নেওয়া। এ ধরনের লোক নিয়োগ দিয়ে সেগুলো ভালোভাবে পরিচালনা করা। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের যেসব নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো কঠোরভাবে পালন করতে হবে। তাহলে এ খাতের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা যাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝেমধ্যে কাউকে রেয়াত দেবে, কাউকে দেবে না। কাউকে বেশি সুবিধা দেওয়া এবং ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এগুলো যখন ঘটে, তখন কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। যখন এভাবে নিয়ম-কানুনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়, তখন নানা ধরনের সমস্যা হয়। তাহলে নিয়ম-কানুন রেখে লাভ কী?

আমরা একটা কথা বলি—রুলস ভার্সেস ডিসক্রিয়েশন; নিয়ম বনাম বিশেষ ক্ষমতা। নিয়মের ওপর ভর করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তখন কোনো বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতার ওপর ভর করলে এবং নিয়ম-নীতিতে অটল না থাকলে তো কাজ হয় না।

ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু নীতি-নৈতিকতা আছে, যেগুলো বহুকাল ধরে চলে আসছে। এর মধ্যে হঠাৎ সরকারের তরফ থেকে কিছু নীতিমালা আসে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অন্য রকম। কিছু বিষয় থাকে, যা স্বাভাবিকভাবে চলে আসছিল, তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। কিছুদিন আগে দেখলাম, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে মানুষ কিন্তু খুশি হতে পারেনি। যা হোক, যেহেতু নিয়ম করা হয়েছে, কাজেই একসময় মানুষ এসব মানিয়ে নিতে শুরু করেছিল। আবার আকস্মিকভাবে যারা পোস্ট অফিসে টাকা রাখে, তাদের সুদহারও কমিয়ে আনা হয়েছে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। এটা কিন্তু কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। কারণ ডাকঘরের যে স্কিম ও সুদের হার, তা করাই হয়েছিল দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত, যারা অল্প টাকা আয় করে তাদের কথা ভেবে। সচ্ছল কোনো লোক কিন্তু খুব কমই ডাকঘরে গিয়ে সঞ্চয় করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোক, গ্রামের মানুষ এবং সাধারণ মানুষ ডাকঘরের সঞ্চয়পত্রে জমা করে। অতএব, কেন এটা করা হলো ঠিক বোধগম্য নয়। এখানে সুদের হার কমিয়ে কয়টা টাকাই বা লাভ করা যাবে? সরকারের অর্থের যদি অপচয় না হয়, দুর্নীতি যদি না হয়, তাহলে বরং অনেক বেশি টাকার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এ ধরনের কাজ আমি বলব যে কোনোভাবেই ন্যায়সংগত হয়নি। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। তারা এমনও ধারণা করছে যে সরকার বলছে, তাদের ভালোর জন্য এসব করা হচ্ছে, এটা ও ওটা করা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তারা ভাবছে, এটা কি আদৌ আমাদের ভালোর জন্য করা হচ্ছে? এটা মোটেও কোনো ভালো লক্ষণ নয়।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিন্তু শুধু কতগুলো সূচক নয়, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। কত প্রবৃদ্ধি হলো, রেমিট্যান্স বাড়ল, রিজার্ভ বাড়ল—শুধু এগুলোই উন্নয়ন নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে কি না, জীবনের মান উন্নত হচ্ছে কি না—এসবও দেখতে হবে। আবার জীবন নির্বাহ করতে আমি ও আমরা খুব কষ্ট করছি কি না, সেগুলোও ভাবতে হবে। এক হিসেবে দেখলে, এসব কিন্তু দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। অতএব, এসব খাতে গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকার অনেক দিন ধরেই বলছে, তারা আর্থিক খাত নিয়ে ভাবছে। কতটা ভাবছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ সমস্যা সমাধানের কোনো অগ্রগতি তো দেখছি না। আবার এখানে আর্থিক খাত বলতে শুধু ব্যাংক নয়; এখানে পুঁজিবাজার আছে। নন-ব্যাংক ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন, বীমা কম্পানিগুলো এবং ডাকঘর সঞ্চয় স্কিম আছে। সব খাতই কিন্তু দিন দিন সমস্যাসংকুল হয়ে যাচ্ছে। এখন যেকোনোভাবেই হোক, এর সমাধান করতে হবে। এ জন্য নানা উদ্যোগ দরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি বলে মনে করি।

ডাকঘরের সুদ ও স্কিম নিয়ে রিভাইজ করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে পরিবর্তন করার আগে চিন্তাভাবনা দরকার ছিল। কারণ যেসব জিনিস সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে এবং যেসব জিনিস বহুকাল ধরে চলে আসছে, সেখানে হঠাৎ করে পরিবর্তন আনার কোনো মানে নেই। পরিবর্তন করাটা ভালো। কিন্তু সব পরিবর্তনই কি ভালো? পরিবর্তনের একটা সংজ্ঞা হলো—চেঞ্জ ফর দ্য বেটার। তা না হলে পরিবর্তন করার দরকার কী? আবার ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যক্তিগত খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, সেটা কিন্তু ১০ শতাংশে চলে এসেছে। যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী তারা কিন্তু সহজে ব্যাংক লোন পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোরও এদের প্রতি একটা অনীহা, বড় ঋণগ্রহীতাকে টাকা দিলে তো তাদের সুবিধা। আবার পুঁজিবাজারে আছে অস্থিরতা। সমস্যা হওয়ার আগে বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার।

ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা আছে। এখন পটও পরিবর্তন হয়েছে। ঝড়-ঝঞ্ঝার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত—এমন নয়; বরং এখানে কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় লেগে যায়। সে কারণে বাইরে থেকে লোক আসতে চায় না। সাম্প্রতিক সময়ে চীনে উদ্ভূত করোনাভাইরাসের কারণে বাণিজ্য একটা ঝুঁকিতে পড়েছে। ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, একসেসরিজ, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় চীন থেকে। এটা একটা ঝুঁকি। বিকল্প ব্যবস্থায় অন্য দেশ থেকে মালামাল আনলে খরচ বেশি পড়বে। এটাও একটা অর্থনৈতিক চাপ। চীনের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের কয়েকটি মেগা প্রকল্পে কাজ করছে। করোনাভাইরাসের কারণে এগুলোর বাস্তবায়নে প্রভাব পড়বে। প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বেড়ে যেতে পারে। সারা পৃথিবীর নানা জায়গায় করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। ব্রেক্সিট থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেছে। এসব ঘটনা বাংলাদেশ বহির্বাণিজ্য বিশেষ করে পোশাকশিল্পের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিকে ভালো অবস্থানে আনতে হলে সমন্বিত, সুচিন্তিত এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে, বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংশ্লিষ্ট উদ্যমী ও সৎ লোকের সঙ্গে পরামর্শ করেই বাস্তবায়নযোগ্য দৃশ্যমান পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন : মাসউদ আহমাদ

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে