আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সংবাদপত্রগুলোতে এ বিষয়ে লেখালেখি ও প্রতিবেদনের সমারোহ। যেকোনো আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আমাদের সাংস্কৃতিক ভুবনে আনুষ্ঠানিকতার কখনো ঘাটতি দেখিনি, কাজে-বাস্তবে অগ্রগতি যতটাই হোক। অবশ্য এর একটা ইতিবাচক দিকও আছে। এ উপলক্ষে অনেক তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যানের সন্ধান মেলে।
বাংলাদেশের সমাজে নারীর শিক্ষার অগ্রগতি, ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রের বিস্তার গত ৭০ বছরে নিঃসন্দেহে লক্ষণীয় মাত্রার। অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যান দুই-ই এ কথা বলে। কী সরকারি, কী বেসরকারি খাতে—বিশেষ করে চিকিৎসাসেবা, ব্যাংক, গণমাধ্যম, করপোরেট হাউস বা এনজিও সংস্থায় নারীর উপস্থিতি প্রকট। স্যালুট করতে হয় বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে।
উদাহরণ হিসেবে একটি দৈনিকের খবর (৮.৩.২০২০) : ‘চিকিৎসা-শিক্ষায় ৬০ ভাগই নারী’। এ তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে উল্লিখিত ৭০ বছরের সময়সীমাটি কাকতালীয় মনে হবে না। কারণ এটি আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত।
১৯৫২ সালের কথা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অতিথি গ্রুপ এসেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। লেকচার গ্যালারি-ভর্তি ছাত্র আর সামনের একটি কাঠের বেঞ্চিতে সাত-আটজন ছাত্রী। তাই দেখে দলনেতা ডা. বাট্রভ বলেন, আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবায় ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। এখানে মাত্র কয়েকটি মুখ। চিকিৎসাসেবায় নারী প্রকৃতির সঙ্গে খুব মিল। এ দিক থেকে আপনাদের অনেক এগিয়ে আসতে হবে। ডা. বাট্রভের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, জানি না সেটা শুধু সংখ্যায় নাকি কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতার বাস্তবায়নে। চিকিৎসা খাত কি আপন সমৃদ্ধিতে সফল, নাকি জনসেবায়ও—এ প্রশ্ন অনেকের মুখে শুনি। অভিযোগ কি শুধু চিকিৎসাসেবা নিয়ে, নাকি সমাজের অন্য সব দিকেও, দক্ষতার পাশে উদাসীনতা নিয়ে এবং তা নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে?
পঞ্চাশের দশকে সূচনালগ্নের উল্লেখ শুধু একটি ঘটনার কাকতালীয় সাদৃশ্যের কারণে। এ দীর্ঘ সময়পর্বে দেশে অনেক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে; কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তখনকার আদর্শিক চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাসগুলোর কি বাস্তবায়ন ঘটেছে? প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথা মূল আলোচ্য প্রশ্ন : উল্লেখযোগ্য নারী অগ্রগতি বা প্রগতির সবটাই কি আলোয় উজ্জ্বল? এবং সমাজের সর্বশ্রেণির? কিংবা আলোচ্য নারী অগ্রগতির ক্ষেত্রেরই?
দুই.
ভালো-মন্দ মিলিয়ে উন্নয়ন হলো মুদ্রার এক পিঠ। আমাদের আলোচনা নারীদের নিয়ে, কর্মক্ষেত্রে ও ক্ষমতায়নে তাদের অগ্রগতির হিসাব-নিকাশ নিয়ে। সেখানে অনেক অগ্রগতি সেই কথিত পঞ্চাশের দশক থেকে একুশ শতকের বিশের দশকের সময় বিচারে। সময়টা দীর্ঘ, তবু আপাত-অগ্রগতিও কম উল্লেখযোগ্য নয়।
কিন্তু আসল সমস্যা অন্যত্র, যেখানে একদিকে কিছুটা শুভংকরের ফাঁকি, সেই সঙ্গে মুদ্রার অন্ধকার পিঠে নারী নির্যাতনের ও সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র। এবং তা কয়েক বছর, বিশেষ করে গত দু-এক বছরে এমন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছেছে যে অপরিণত বয়সী বা তিন/চার/পাঁচ বছর বয়সী শিশুকন্যারাও বর্বর ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
এমনকি ২০২০-এ মুজিববর্ষের ঘোষণায় ও তৎপরতায় এবং ২০১৯-এর ভয়াবহতায় এ বিষয়ে নারী-পুুরুষ সমাজের প্রতিবাদী সচেতনতার মুখে আমরা ভেবেছিলাম অন্তত এ বছরে এ পাপাচারের হার কমে আসবে; কিন্তু বর্ষ শুরুর পরিসংখ্যান তা বলে না। প্রতিদিনের দৈনিকগুলোতে নারী ধর্ষণের খবর, বয়স-নির্বিশেষে।
এ পরিস্থিতিতে কি নারীর অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা চলে, বিশেষত যদি নারীর ওপর সহিংসতার হার ও তার নৃশংসতার গুণগত পরিমাপ করা যায়? ধর্ষক দুর্বৃত্তদেরই যে জয়, তার পরিচয় মেলে যখন দেখা যায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও নারী নির্যাতন, বিশেষ করে শিশুকন্যা ধর্ষণ।
নমুনা হিসেবে আমি মাত্র দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করছি, করছি শুধু সংবাদ শিরোনাম : ‘তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ’। ভাবা যায় রাজধানীতে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে ৪২ বছর বয়সী ফরিদ শেখ নামের এক বর্বর? প্রশ্ন: ধর্ষণ সম্ভব তিন বছরের শিশুকে?
একই দিনে ‘রাজধানীতে ধর্ষণ সাত বছরের আরেক শিশুকে’। শিশুটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। প্রথম প্রতিবেদনের আরেকটি খবরে প্রকাশ, জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। দুটো পত্রিকার খবর।
বলতে হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দুর্বৃত্তদের উপহার। অন্য পত্রিকাগুলোর পরিবেশিত খবরে আরো কয়টি এমন খবর মিলবে কে জানে। তেমনি থাকে একাধিক অপরিবেশিত অনুরূপ ঘটনা, সাধারণত দূর গ্রামাঞ্চলে, সাংবাদিকদের এখতিয়ারের বাইরে।
তিন.
নারীর প্রতি বাংলাদেশি সমাজের এই জঘন্য আচরণ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। যেমন স্বদেশি প্রশাসন তেমনি আন্তর্জাতিক মহলের সচেতন দৃষ্টি এদিকে কমই পড়ে। আন্তর্জাতিক বিশেষ সংস্থা বা জরিপে শুধু দৃষ্টি পড়ে পোকায় খাওয়া গাছের উঁচু উঁচু ডালে—তারা দেখেন শিক্ষিত নারীর ক্ষমতায়ন বা কর্মক্ষেত্রে অগ্রগতির দিকগুলো চোখে পড়ে না আলোর নিচে অন্ধকারের বিস্তৃত দিকগুলো। চোখে পড়ে না বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরী-তরুণী-নারী, পোশাককর্মী, দরিদ্র গ্রামীণ পরিবার বা শহুরে বস্তিবাসী শিশু-কিশোরীদের প্রতি, যারা দুর্বৃত্তদের হাতে ধর্ষণের সহজ নিষ্ঠুর শিকার।
বিশেষ করে শিশুকন্যা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থার পরামর্শ তো আন্তর্জাতিক মহল থেকেও আসা উচিত। বিশেষ করে যারা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বাসী ও উৎসাহী।
তবে এ কথা ঠিক যে প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাথমিক দায়িত্ব স্বদেশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের, আর বিশেষ করে যারা সমাজে নারীর ক্ষমতায়নে, কর্মস্থলে অগ্রগতির প্রচারে পঞ্চমুখ। মুদ্রার উজ্জ্বল দিকের অপর পিঠের গাঢ় কালো অন্ধকারের দিকে তাদেরই তো দৃষ্টি পড়ার কথা সবার আগে।
দীর্ঘ স্তব্ধতার পর এ বছর বা ইদানীং বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ সরব ও সোচ্চার হয়েছেন, লক্ষ করা যাচ্ছে। এন্তার বিশ্লেষণমূলক লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিকার ও করণীয় সম্পর্কে পরামর্শেরও অভাব নেই। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে তাত্ক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা কি নেওয়া হচ্ছে?
আমরা তাই অবাক হই না যখন সংবাদপত্রে এমন শিরোনাম চোখে পড়ে : ‘সহিংসতা-বঞ্চনায় ম্লান নারীর অগ্রগতির অর্জন’। এ প্রতিবেদনটি একটু ভিন্ন চরিত্রের এবং এতে অপেক্ষাকৃত অবহেলিত খাতের নারীর প্রতি আচরণের বৈষম্য এবং তাদের পিছিয়ে পড়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
আসলে লক্ষ করার বিষয় যে নারীর অগ্রগতি, ক্ষমতায় অংশগ্রহণ, কর্মস্থলে সংখ্যাগত আধিক্যের যে দিকগুলো সরবে প্রচার করা হয় সেটা পুরোপুরি সম্পন্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণি ও পরিবারের অন্তর্গত। পূর্বোক্ত কর্মস্থলগুলোর দিকে এবং ওই সব স্মার্ট, সুদর্শনাদের পারিবারিক পরিচয় নিতে গেলে ওই শ্রেণিগত দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতাবলয়ে অংশীদাররা তো সবাই উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়।
নারীর অগ্র-পশ্চাৎ অবস্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এর শ্রেণিগত দিক। এমনকি মজুরির ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। আর তা হলো বৈষম্য ও বঞ্চনার সবটুকুই নিম্নবর্গীয়দের ক্ষেত্রে, উচ্চস্তর ক্ষেত্রে নয়। নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তরাও অংশত উল্লিখিত বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার। বিস্ময়কর সাদৃশ্য হলো নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন বা সহিংসতা সর্বাধিক শেষোক্ত শ্রেণিতে। পোশাক শ্রমিক ধর্ষণের ঘটনাবলি তো কিংবদন্তিতে পরিণত, যেন ওরা ধর্ষণের যোগ্য পাত্রী, অথবা ওরা উপভোগের জন্যই জন্মেছে।
তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যারা ধর্ষক তারা প্রধানত বখাটে ধনীর দুলাল, করপোরেট সংস্থার মালিক বা সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, পোশাক কারখানার মালিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা ম্যানেজার, ক্বচিৎ সেকশন কর্মকর্তা। তবে তেমনই বিস্ময়কর মাদরাসা শিক্ষক বা অধ্যক্ষ, কোচিং শিক্ষক ইত্যাদি। শ্রেণিগত প্রভেদ শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে প্রকট। সর্বোপরি গ্রামের অতিদরিদ্র বা দিনমজুরদের কন্যারা বড় অসহায় অবস্থানে। অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, একদা নিত্যদিন ধারাবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েও পোশাককর্মীরা কর্মত্যাগ করেনি। তাদের জন্য এটা জীবনসংগ্রামের অংশ।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী