১০, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩, ২, ১, ০। ক্ষণগণনা শেষে সূচনা হলো বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। আজ শত বছর পূর্ণ হলো বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানের। শুভ জন্মদিন জাতির পিতা। সোমবার (১৬ মার্চ) দিবাগত রাত শূন্যঘণ্টা শেষে ১৭ মার্চের সূচনালগ্নে শুরু হওয়া বহুল প্রতীক্ষিত মুজিব জন্মশতবর্ষ বছরজুড়ে উদযাপিত হবে। চলবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত আটটায় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনটি এখন জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আনুষ্ঠানিক আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সীমিত করা হয়েছে এসব কর্মসূচি। তাই বলে বাঙালি জাতির মনে বঙ্গবন্ধুর পৃথিবীতে আগমনের দিনটির আলোকপ্রভা একটুও ম্লান হয়নি। তাদের অন্তরের অন্তস্তলে জাতির পিতার জন্মদিন উদযাপনের উচ্ছ্বাস অনুরণন তুলছে প্রতিক্ষণ।
জন্মদিনের পুনর্বিন্যিাসিত কর্মসূচিতে আজ রাষ্ট্রীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। রাত আটটায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজির মধ্য দিয়ে জন্মশতবর্ষের কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। এর আগে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন। ভাষণের পরপর আতশবাজির মাধ্যমে জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।
গত ১০ জানুয়ারি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে (জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড) ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ক্ষণগণনার উদ্বোধন ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে এই বিমানবন্দরে পদার্পণ করে দেশে ফেরেন।
জাতি যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ মুজিববর্ষের সূচনা ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হবে। দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রেকর্ড করা ভাষণ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি রেডিও-টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে সারা দেশে বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানান, বড় ধরনের জমায়েত পরিহার করে উৎসবমুখর পরিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে অন্যান্য কর্মসূচি পালন করা হবে।
সারাদেশে একসঙ্গে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান দেশের সব গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
মুজিবর্ষ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ সকাল সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের সব আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল সাতটায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির একটি প্রতিনিধিদল টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও দোয়া মাহফিলে অংশ গ্রহণ।
আজ রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু জন্মক্ষণ উপলক্ষে সারাদেশে একযোগে আতশবাজি প্রদর্শনী হবে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ৩২ নং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে এবং ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই আতশবাজি প্রদর্শনী হবে।
এ ছাড়া ঢাকার রবীন্দ্র সরোবর, হাতিরঝিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি ও জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় আতশবাজি প্রদর্শনী হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন। তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এই ভাষণ ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে (২৬ মার্চ) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম।
সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হন। বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন।
- আরও পড়ুন >> শতবর্ষের শত সংগ্রাম শেষে
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন বাঙালির স্বাধীনতার স্থপতি।