কেউ কি ভাবতে পেরেছিল একদা প্লেগের মতো ভয়ানক এক ভাইরাস বিশ্বসমাজকে কাঁপিয়ে দেবে, আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে থাকতে চাইবে? চমকপ্রদ একটি খবর। এমন যে দুর্দান্ত যুদ্ধবাজ মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি কাউকে ভয় পান না, পাত্তা দেন না তিনিও করোনাভাইরাসের আক্রমণ-ক্ষমতার ব্যাপকতা দেখে উদ্বিগ্ন। তবে তিনি কানাডাসহ ইউরোপের একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো ঘরে বসে অফিস করছেন না।
অবিশ্বাস্য ঘটনাই বলতে হবে, আবার সেই ইউরোপ—এবার প্লেগ নয়, মারাত্মক করোনাভাইরাস। প্লেগজীবাণু দমন একালে কোনো সমস্যাই নয়; কিন্তু বেশির ভাগ ভাইরাসের বিরুদ্ধেই কার্যকর ভেষজ আবিষ্কৃত হয়নি, যাকে বলে গবেষণার সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা। আর নতুন কোনো ভাইরাস হলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে যদি তার সংক্রমণ বিস্তারের ক্ষমতা ব্যাপক হয়, তার নাশকতার ক্ষমতা অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়।
অবস্থাদৃষ্টে ইউরোপকে মহামারির কেন্দ্রস্থল ঘোষণা করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, যদিও এই প্রাণঘাতী মড়কের সূচনা—মহাচীনের একটি প্রদেশে। এরপর মহামারির চরিত্র নিয়ে উহান শহর থেকে এর বিস্তার। কিন্তু চীনারা এতই করিৎকর্মা যে তারা জাতীয় পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে আক্রান্ত প্রদেশটিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে প্রচণ্ড নির্মমতায় করোনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।
এবার কিছুটা স্বস্তি নিয়ে তাদের এক কূটনীতিকের অভিযোগ, ‘মার্কিন সেনারা উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ক্রীড়াবিদদের মাধ্যমে এর সূচনা। অবশ্য এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেশ মজা করে করোনাভাইরাসকে ‘উহানা ভাইরাস’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন। এর তাৎপর্য হলো, চীনই এই ভাইরাসের উৎস।
এই কূটনৈতিক বাহাস মহামারির মতো দুর্যোগে অনভিপ্রেত। যেহেতু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই ভাইরাসের আক্রমণ বৈশ্বিক মহামারির (‘প্যান্ডেমিক’) চরিত্রের, কাজেই প্রতিরোধব্যবস্থা হতে হবে তেমনই বৈশ্বিক, সর্বাত্মক চরিত্রের। রোগ-মহামারি সীমানা বিবেচনা করে না, তার ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। সে জাতি, ধর্ম, বর্ণ মানে না। পথ চলতে যাকে সামনে পায় তার ওপরই আক্রমণ চালায়।
দুই.
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে যতটা না এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, তার চেয়ে বেশি ইউরোপের দেশে দেশে। পর্যটনবিলাসী হওয়ার কারণেই কি ইউরোপের এ তাত্ক্ষণিক দুর্দশা, নাকি যেকোনো প্রকার ব্যাধির সমস্যা নিয়ে ওরা অতিসচেতন বলে যতটা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি রটেছে। অর্থাৎ তারা সর্বাত্মক প্রতিরোধব্যবস্থা নিচ্ছে বলেই ঘটনা এতটা প্রচার পেয়েছে এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকা অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যসচেতন, রোগব্যাধির ক্ষেত্রে তেমন স্পর্শকাতর বলে যথাযথ মাত্রায় তাদের সতর্কতা ও সাবধানতা। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন করোনাবাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং বিস্তার রোধের সংকল্প নিয়ে।
তবে করোনা আক্রমণের প্রকাশিত বৈশ্বিক চিত্রের দিকে তাকালে একে ‘বিশ্বমারি’ (‘প্যান্ডেমিক’) বলা বোধ হয় খুব একটা ভুল হবে না। একটি দৈনিকের পরিসংখ্যান মতে (১৪.৩.২০২০) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ এবং তাতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১২২ জন। সর্বাধিক আক্রান্ত চীনে ৮০ হাজার ৮৩৭, মৃত তিন হাজার ১৮৫ জন।
ইউরোপে সর্বাধিক আক্রান্ত অবরুদ্ধ দেশ ইতালি। দেশটি নিয়ে প্রবল আতঙ্ক। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ১১৩ এবং মৃত ৫৯৯ জন এবং জরুরি অবস্থা জারির দেশ স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫২২ এবং মৃত ১৫৮ জন। অন্যদিকে এশিয়ার যে দেশটি নিয়ে তেমন কোনো প্রচার বা চিৎকার নেই, অথচ সেই ইরানে আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৬৫৩ এবং মৃত ৫৯৯ জন। এ চিত্রানুযায়ী বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে।
ভাবা গিয়েছিল ভালো অবস্থানে আমাদের জনবহুল বসতির অপর পিঠে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরা বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক সংখ্যায় মৃত্যুর মধ্যেও বেশ ভালোই ছিল। যত রক্তপাত ইউরোপে। কিন্তু করোনা কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না।
কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ব্রিটেন সফরে গিয়েই যত সর্বনাশ ঘটিয়েছেন, করোনাকে দেহে বহন করে নিয়ে এসেছেন। ফলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে গেছেন এবং দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে সাজো সাজো রব, ঘোষণার পর ঘোষণা, সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
তিন.
কী ভাবছে করোনাভাইরাস? সূচনার কারণ যা-ই হোক, দায় যারই হোক, একবার যখন বোতলে বন্দিদশার মতো অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে, তখন গোটা পৃথিবীটা ঘুরেফিরে দেখা যাক। তাই চীন ছেড়ে তার যাত্রা শুরু ইউরোপে এবং সেখান থেকে আফ্রিকার দেশগুলোতে। কেনিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান ও গিনি। কৃষ্ণ মহাদেশের পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস কতটা তার অনুকূলে সেই ভেবেই বোধ হয় এই যাত্রা।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্ত থাকলেও করোনা সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরিডা রিসোর্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষৎকার শেষে ঘরে ফিরেই আক্রান্ত। ট্রাম্পপ্রীতির মাধ্যমে দেশটিতে করোনাকে নিয়ে এসেছেন অতিথি করে। দেখা যাক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
রাজনীতি-কূটনীতির সহায়তা নিচ্ছে করোনাভাইরাস রাষ্ট্রপ্রধান, নির্বাহীপ্রধান বা কূটনীতিকদের মাধ্যমে। তা ছাড়া পর্যটকরা তো সর্বোত্তম মাধ্যম। পূর্বোক্ত ধারায় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর পরিদর্শনের খেসারত দিতে হচ্ছে ফিলিপাইনের কূটনীতিককে। ঘরে ফিরে বোঝা গেল তিনি করোনায় আক্রান্ত। এমনকি বাদ নয় ওয়াশিংটন ডিসি। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে এক বৈঠকে যোগ দিয়ে ঘরে ফেরার পর বুঝতে পারেন তিনিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
বিশ্বজুড়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এত সতর্কতা জারি ও ঘোষণাদির পরও রাষ্ট্রনীতিক-কূটনীতিকদের হুঁশ হয়নি, এখন দেশ ভ্রমণটা একটু বন্ধ রাখি। দায়টা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এবং জাতিসংঘের সদর দপ্তরের অনবধানতা। যুক্তরাষ্ট্র কি ঘটনা চেপে রেখেছিল? অপরাজেয় শক্তিমান আভিজাত্যবোধ থেকে? তাকে জয় করবে কে?
কিন্তু করোনাভাইরাস সে কথা শুনবে কেন, মানবে কেন? সে ভেবেছে কৃষ্ণাঙ্গ মহাদেশের পর মহাক্ষমতাধর উত্তর আমেরিকা নামক মহাদেশকে জয় না করলেই নয়। নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে সেখানে। যুক্তরাষ্ট্র সফরের মাধ্যমে একাধিক দেশে তার সফরের সুযোগ ঘটে গেল। বিচ্ছিন্ন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটিও করোনার আওতায় এসে গেল।
আমাদের প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এত দিন নীরব ছিল কেন? অবস্থাদৃষ্টে এমন প্রশ্নও উঠতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বয়ং কি এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের ধারক-বাহক? তাঁর সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট আক্রান্ত, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বহাল তবিয়তে আছেন, রহস্যটা কী? আর এত দিন পর আজ জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা (১৫.৩.২০২০) কেন? ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’ তিনি?
সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ, এ মুহূর্তে ‘দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ১৭৫’ জন। ‘তাদের মধ্যে মারা গেছে ৪৭ জন।’ এ ঘটনা তো এক দিনে ঘটেনি। তা সত্ত্বেও করোনা আক্রমণ নিয়ে এত দিনকার নীরবতার কী কারণ, কী ব্যাখ্যা, আমাদের জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এত দিন অজেয় ছিল, এবার করোনাভাইরাসই জয় করল যুক্তরাষ্ট্র, যদিও তা সাময়িক।
কী করছে নিউ ইয়র্কস্থ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, কী কী বিধান দিচ্ছে। বলেছিলাম বাংলাদেশ ভালোই আছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশকেও দ্রুত কঠিন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব বিভাগকে একপায়ে খাড়া থেকে প্রতিরোধব্যবস্থা শাণিত করে করোনার মোকাবেলা করতে হবে। জরুরি, সমাজ-সচেতনতার ব্যক্তি সচেতনতা।
উন্নত দেশের ব্যবস্থা গ্রহণ পদ্ধতি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে, কী কী ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা সর্বোত্তম ফল পেতে পারি। বিচ্ছিন্নতাকরণ ব্যক্তি বা পরিবারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, বিদেশাগতরা নিয়ম রক্ষা করছেন না। দায়িত্বহীনতায় তো আমরা তুলনাহীন। তাই ব্যবস্থাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগকেই নিতে হবে সর্বাত্মক সাহায্য নিয়ে। ব্যাপক আক্রমণের জন্য অপেক্ষা না করে সূচনাতেই সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বোত্তম নীতি বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> আলো-আঁধারে নারীর জীবনসংগ্রাম