বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব শেয়ারবাজারে ধস চলছে। নেতিবাচক প্রভাব প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও। গতকাল বুধবার করোনা আক্রান্ত হয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর খবর দিয়েছে আইইডিসিআর। এরপর শেয়ারবাজারেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এর আগে গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ পেলে এর প্রভাবে পরদিন ৯ মার্চ শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স এক দিনে রেকর্ড ২৭৯ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর একে একে আট দিন চলে গেলেও বড় ধসের কবল থেকে বেরুতে পারেনি শেয়ারবাজার।
এমতাবস্থায় করোনা ভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় লেনদেন এক ঘণ্টা কমিয়ে এনেছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। গতকাল পরিচালনা পর্ষদের জরুরি বৈঠকে লেনদেন এক ঘণ্টা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত লেনদেন হবে।
তবে, এটি ভুল সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, বিনিয়োগকারীরা দুই সপ্তাহ বাজার বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তবে এমন পরিস্থিতি হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ডিএসই ব্রোকার্স ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ভয়াবহ ধসের কবলে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণাও ধস ঠেকাতে পারছে না। দিনটিতে প্রধান শেয়ারবাজারে মোট ৯৪ ভাগ কোম্পানির দর কমেছে। এই পতনের কবলে পড়ে শেষ ১০ কার্যবিসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ৮৬৩ পয়েন্টই নেই হয়ে গেছে। অর্থাৎ দিনটিতে গত সাত বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে ডিএসইর সূচক।
অবশ্য দিনের লেনদেনের শুরুতে শেয়ারবাজারে বড় উত্থানের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র ৫ মিনিটের লেনদেনে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ১০৮ পয়েন্ট বেড়ে যায়। কিন্তু এই উত্থান প্রবণতা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। লেনদেনের সময় আধা ঘণ্টা পার না হতেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দরপতন হতে থাকে।
ফলে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ১৬৮ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ৬১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২০৩ পয়েন্টে এসে পৌঁছেছে। আর ডিএসইর শরিয়াহ সূচক ৩৯ পয়েন্ট কমে ৮৩৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। বাজারটিতে লেনদেন অংশ নেয়া মাত্র ১৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৩৩টির। আর ১০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
পতনের এই বাজারে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪২৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৪০৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
অপর শেয়ারবাজর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই ৪৪২ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ১৩৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। বাজারটিতে লেননে হয়েছে ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২২১টির এবং ৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ মত ও পথকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারের লেনদেনের সময়সীমা কমানোর সিদ্ধান্ত ভূল হয়েছে। এতে করে বিনিয়োগকারীরা আরো আতঙ্কে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী গত ১৬ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটি মানতে হবে। কেন ব্যাংকগুলো মানছে না বা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছে না সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
অর্থমন্ত্রীর বৈঠকের পরও কেন বাজারের বড় পতন হলো এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘এর কারণ খুঁজে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া লেনদেন সাময়িক বন্ধ করা কোন সমাধান নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।’
বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী মত ও পথকে বলেন, লেনদেনের সময়সীমা কমানোর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অনৈতিক। কারণ যদি কোন রোগীর ক্যান্সার হয় সেখানে যদি জ্বরের ওষুধ দেয়া হয় তবে কি সেটির উন্নতি হবে? হবে না। সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজরকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। সামন্য সময়ের জন্য সাপোর্ট দিয়ে কোন লাভ হবে না। এই মুহূর্ত বাজার ২ সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। এরপর বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, ডিবিএ, আইসিবি, মার্জেন্ট ব্যাংক, বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সমস্যা নির্ধারণ করে সমাধান করতে হবে।’
স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ করা ঠিক হবে না উল্লেখ করে ডিএসই ব্রোকার্স ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী মত ও পথকে বলেন, ‘লেনদেন বন্ধের মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। কারণ ডিএসইর লেনদেন ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা হচ্ছে।’
এক ঘণ্টা লেনদেন কমের সিদ্ধান্ত ঠিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ডিএসই হয়তো বুঝে শুনে নিয়েছে। তবে এটা সমাধান না। ডিএসইকে প্যানিকের জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। এটি খুঁজে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বর্তমানের এ পতন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে। এবং করোনার অবস্থা যদি দিন দিন খারাপের দিকে যায় সেক্ষেত্রে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিবে সেটি পরিষ্কার করতে হবে। তবেই বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। অন্যথায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’