মানব সমাজের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন যুগে বা শতাব্দীতে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। তখন সেসব রোগবালাই মহামারির আকার ধারণ করে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করেছে। মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রাচীন বা মধ্যযুগে প্রধানত কলেরা, প্লেগ, গুটিবসন্ত বা শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলোই বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীনকালে ও মধ্য যুগে প্লেগ মহামারিতে সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ঘটে থাকলেও এশিয়ার বহু দেশে দীর্ঘকালজুড়ে প্লেগ মহামারিতে অসংখ্য মানুষের জীবনহানি হয়েছে। ভারতবর্ষে ১৮৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল নাগাদ ১০৫ বছরব্যাপী প্লেগ মহামারি হিসেবে চলমান ছিল ও প্রায় ৩ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিল।
গুটিবসন্ত মহামারিতে সারা বিশ্বে আনুমানিক ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষের জীবনহানি হয়েছে। এই রোগটি গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ আমাদের দেশেও বিদ্যমান ছিল। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ রোগের নানাবিধ নিরাময় পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে ও তা প্রয়োগ করে মানবসমাজ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় তন্ত্র-মন্ত্রের স্থলে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রতিষেধক আবিষ্কার অসহায় মানব সমাজকে যেমন মহামারির প্রকোপ থেকে রক্ষা করেছে ঠিক তেমনিভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, অপরিকল্পিত ও অবিবেচনাসুলভ বর্জ্য নিক্ষেপ, প্রকৃতিতে ও পরিবেশে মানুষের অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারসহ বহুবিধ কারণে নতুন নতুন রোগজীবাণুর উদ্ভব ঘটেছে ও মানব সমাজকে সম্পূর্ণ নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে ও করে যাচ্ছে।
এইচআইভি এইডস, ইবোলা, হিনি, বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লু, ডেঙ্গু এবং করোনা ভাইরাস বর্তমান যুগের রোগ যেগুলো সামাল দিতে পুরো পৃথিবীর রাষ্ট্র ও সমাজগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। একমাত্র এইডস রোগেই গত চার দশকেরও কম সময়ে প্রায় ৪ কোটি লোকের প্রাণহানি হয়েছে। এ রোগের ফলপ্রসূ প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় এটি এখনো চলমান মহামারি হিসেবে চিহ্নিত। তবে যেহেতু মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনযাত্রা পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, সেহেতু আগের তুলনায় এ রোগে মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। হিনি রোগে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল এই দুই বছরেই বিশ্বব্যাপী ১০ কোটি মানুষ মারা গেছে। এ ধরনের বিপুল মানবিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি মানবসমাজ প্রত্যক্ষ করেছে সারা ইতিহাসজুড়ে।
বর্তমানে এসব রোগসহ প্রায় সব রোগেরই চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশে মানুষের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি ও জীবাণু মারণাস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া ও প্রতিযোগিতা মানবসমাজকে নতুন নতুন মরণঘাতী রোগের সম্মুখীন হতে বাধ্য করছে। ইবোলা ভাইরাসে মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। এ ভাইরাসজনিত রোগটি এখনো আফ্রিকাতেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ আছে। তবে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যে কোনো সময়। ডেঙ্গু ও বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন দেশে ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হয়ে রয়েছে।
চীনের হুবেই প্রদেশে নোভেল করোনা প্রথম ছড়ায় ও দ্রুত বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোগটির কেন্দ্রবিন্দু চীন থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হয়। বিশেষত ইতালি- যে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে সেখানে বর্তমানে মৃত্যুর ও আক্রান্তের হার সব চেয়ে বেশি। অনেকের মতে চীনের হুবেইতে এ রোগটি শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানো হয়নি, যা সঠিক কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও এটা ঠিক যে কয়েকশ রোগীর মৃত্যুর পরই কেবল বিশ্ববাসী এ রোগটি সম্পর্কে অবহিত হয়। এ ধরনের বিলম্বিত খবর প্রকাশ তিনটি কারণে হতে পারে। প্রথমত, চীন হয়তো রোগটিকে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। দ্বিতীয়ত, তারা হয়তো বিশ্বাস করেছিল যে এটি মহামারির আকার ধারণ করবে না। তৃতীয়ত, হয়তো এটি শনাক্তকরণেই দুর্বলতা ছিল, যা সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ। কার্যকারণ যাই হোক না কেন, করোনা ভাইরাসের এবারের বিস্তার লাভ বিশ্বকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ ও সার্বিকভাবে মানবসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর এই বৈশ্বিক মহামারি একটি দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বলাই বাহুল্য। ইতালিতে মৃত্যুর বর্তমান হার বিবেচনায় নিলে এবং এই ভাইরাসকে এখনি কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে বা আবহাওয়াজনিত কারণে এর বিস্তার রোধ না হলে এই রোগে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ভারত উপমহাদেশে প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নতুন এ ভাইরাসটির উত্থান ও দ্রুত বিস্তৃতি লাভের পেছনে বিভিন্ন দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের প্রাথমিক আচরণ অনেকাংশে দায়ী। প্রসঙ্গত ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষত ইতালিতে এর মহামারির আকার ধারণের কারণ এই যে এ রোগের প্রাথমিক স্তরে সে দেশের সাধারণ মানুষ যথানিয়মেই প্রাত্যাহিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। অফিস-আদালত, শপিংমল, কেনাবেচা, নাইট ক্লাব, সমুদ্রসৈকত, পর্যটনসহ কোনো কিছুই বন্ধ হয়নি বেশ কিছুকাল। এ ধরনের জনসমাগম স্পেনসহ অন্যান্য দেশেও বিদ্যমান ছিল সম্ভবত এই প্রত্যাশায় যে সুদূর চীন থেকে আসা এ ভাইরাস হয়তো তেমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ ইউরোপের দেশগুলোতে করবে না। এছাড়া এসব দেশের সাধারণ মানুষ ও সম্ভবত সরকারও এমন চিন্তা ধারণ করেছিল যে তাদের অতি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সম্পূর্ণ সক্ষম। সে ধারণা বলাই বাহুল্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আজকের পৃথিবী অবলোকন করছে এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূতের উত্থান, যার দীর্ঘায়িত বিচরণ গোটা মানব জাতিকে এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫১ জন। মৃতের সংখ্যা ৫, সুস্থ হয়েছেন ২৫ জন। আক্রান্ত ও মৃতের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে সম্প্রতি বিদেশ থেকে আগমনকারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া এক বিপজ্জনক লক্ষণ। কারণ অতীতের প্রতিটি মহামারির তিনটি স্তর দেখা গেছে। এগুলোর শুরু হয় ধীরে, তারপর অতি দ্রæতগতিতে তা বাড়তে থাকে ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এটিকে মহামারি বলা যায় না। অথচ এ রোগের সার্বিক চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যে কোনো মুহূর্তে এটিকে প্রচÐ ক্ষতিকর মহামারিতে রূপান্তরিত করতে পারে। আর তাই এর প্রতিকারে সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সার্বিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা প্রতিনিয়ত নানা মাধ্যমে নিজেদের ও অপরকে বিপদমুক্ত রাখার প্রয়োজনীয় উপদেশাবলি পেয়ে যাচ্ছি। এসব বিধি-বিধান মেনে চললে অনেকাংশেই আমরা বিপদমুক্ত থাকতে পারি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এ চ্যালেঞ্জ সুকঠিন এ কারণেই যে, এসব দেশের চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশাল মহামারি প্রতিরোধে অনেকখানি পিছিয়ে আছে। এসব দেশে সেবাদানকারী চিকিৎসকের নিরাপত্তামূলক কোনো সুবিধা নেই, কাজেই রোগীর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক, সেবক ও অন্য ব্যক্তিরা যাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীকে প্রত্যক্ষভাবে সেবাদান করতে হচ্ছে তাদের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়া জরুরি।
অধ্যাপক ড. জহুরুল আলম : প্রেসিডেন্ট, গভর্ন্যান্স এন্ড রাইটস সেন্টার (জিআরসি)।