মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মস্তবড় এক পরাশক্তি—যেমন দেশের আয়োজনে ও সামরিক শক্তিতে, তেমনি অর্থনৈতিক শক্তিতে এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চা ও গবেষণায়। কাজেই তার আর ভয় কাকে। যেকোনো ধরনের দুর্যোগের মোকাবেলায় তার সক্ষমতা প্রশ্নাতীত। স্বভাবতই দেশের প্রধান শাসনকর্তার মনোভাব সমান্তরাল ধারায় চলে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাই নিজেকে বিশ্বের সর্বশক্তিমান রাজনৈতিক নেতা বলে মনে করে থাকেন। তবে ব্যক্তিভেদ, প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্যভেদে এ ধারণার কিছুটা ইতরবিশেষ ঘটে—প্রধানত দুর্যোগে-দুর্ভোগে। তখন মনে রাখতে হয় যে প্রকৃতি নামক প্রচণ্ড এক শক্তিমানের অস্তিত্ব বিরাজমান, যার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মানবশক্তি তুচ্ছ বা গৌণ।
প্রাকৃত শক্তির প্রকাশ প্রত্যক্ষরূপের ভয়াল ভয়ংকরতায়, পরোক্ষে ও নানা প্রতীকে অধিকতর মারণরূপে, যা ভাবনার অতীত, মানুষ এ পর্যন্ত তাকে পরিপূর্ণভাবে জয় করতে পারেনি, সাময়িক সামাল দিয়ে আত্মরক্ষা করেছে, এই যা। এ ভুবন যতটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের, তার চেয়ে অনেক বেশি মারণ রোগ-ব্যাধির, জীবাণু বা অণুজীবের (ভাইরাসের) কিংবা তার রহস্যময় প্রাণঘাতী রূপের (ক্যান্সার)। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকরা এ ক্ষেত্রে এখনো বড় অসহায়—তবে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন, এই যা।
আশ্চর্য, অ্যাস্ট্রোফিজিকস বা মহাকাশবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি, আবিষ্কার ও অগ্রগতি সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের উল্লিখিত দিকগুলো গবেষণামাত্রায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত।
তদুপরি চলছে প্রকৃতির ওপর নানা মাত্রিক অত্যাচার। এদিক থেকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সবচেয়ে এগিয়ে। বাদ যাচ্ছে না স্বল্পোন্নত, অনুন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে গাঢ় কালো ধোঁয়ার কার্বন নিঃসরণে। জলবায়ু সম্মেলনগুলো ব্যর্থ পরাক্রান্ত দেশগুলোর উদাসীনতায়। প্রকৃতির ভারসাম্য বিপর্যস্ত। তাতে তাদের যায় আসে না, নিজ স্বার্থ ঠিক থাকলেই হলো।
দুই.
এর মধ্যে জীবাণু বা অণুজীব ভুবনে তার স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না, এমন ভাবনা বাতুলতা। বিজ্ঞানীরা কি এসব দিক ভাবেননি, কিংবা ভাবলেও পরাক্রান্ত কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনার বাইরে কাজ করার সাধ্য তাঁদের নেই? যুগটা অনেকখানিই পাল্টে গেছে। আইনস্টাইনদের আমলে বিজ্ঞানীর যেটুকু স্বাধীনতা ছিল, এখনকার পরাক্রান্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শাসনযন্ত্রের অধীনে সম্ভবত তা নেই।
তা না হলে চরম মানবতাবিরোধী জীবাণুযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা চালাতে বিজ্ঞানীর বিবেক সায় দেয় কিভাবে? যাকে বলে মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি মানবেরই হাতে। আমি বলছি না, করোনাভাইরাস এজাতীয় পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত, সুস্পষ্ট প্রমাণ ও তথ্য ছাড়া কোনো অভিযোগ তোলা নীতিবিরুদ্ধ কাজ।
তাই করোনাভাইরাসের উৎস বা দায়টা আপাতত উহ্যই থাক। আমরা মূল আলোচ্য প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে দেখতে পাই, মারাত্মক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সূচনা যদিও চীনের একটি নির্দিষ্ট প্রদেশে, তার প্রকোপ যতটা ছড়াল চীনের অন্যত্র, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত বেগে ইউরোপের বিশেষ কয়েকটি রাষ্ট্রে, বিশেষ করে ইতালি ও স্পেনে। ইতালির খ্যাতি রয়েছে তার শিথিল শাসনব্যবস্থার জন্য।
তার মাসুল গুনছে ইতালি সর্বাধিক মৃত্যুর সংখ্যায়। যে চীনে প্রথম আক্রমণের বড়সড় সংখ্যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা এত বড় দেশের তুলনায় অনেক কম। এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে স্পেন। ইউরোপের মধ্যে করোনার থাবায় সর্বাধিক ভয়াবহ অবস্থা ইতালি ও স্পেনে। দুর্বোধ্য কারণে স্পেন এ দুর্ভোগে আক্রান্ত। এর কারণ কি শাসনযন্ত্রের শিথিলতা বা গাফিলতি?
চীন তার বিশেষ শাসনযন্ত্রের ‘টাইট রোপ ওয়াক’ ব্যবস্থার কারণে চরম নিয়মনিষ্ঠ একটি যান্ত্রিক জাতিতে পরিণত, আর সে কারণে একটি ভয়াবহ ভাইরাস আক্রমণের দুর্যোগ সামাল দিতে পেরেছে। যে জন্য আক্রান্তের হার দ্রুত কমে এসেছে, আর এত বড় দেশে মৃতের সংখ্যা এত কম। ওদের অনুসরণে বা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার গুণপনায় দক্ষিণ কোরিয়াও করোনাভাইরাসের আক্রমণ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পেরেছে।
তিন.
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক করোনাভাইরাস আক্রমণের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তিমত্তার প্রেক্ষাপট বিচারে। একাধিক বৈশ্বিক দুর্যোগ-দুর্ভোগ তাকে সামান্যই স্পর্শ করেছে বা করেনি তার অবস্থানগত এবং অন্যবিধ কারণে, যদিও ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও সমাজ বিপর্যস্ত। হয়তো সেসব কারণেই এবং এবার করোনা দুর্যোগে নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে নিয়ে ব্যতিক্রমী স্বভাবের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব যখন করোনাভাইরাসে পুড়ছে, তখন বাঁশি না বাজালেও তাঁর নিরাপদ অফিসে বসে আরামে-আয়েশে চেয়ারে ঘুরপাক খেয়েছেন। তাঁর বড় চিন্তা অর্থনীতি, কারণ তিনি ব্যবসায়ী।
বারবার তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন, করোনা তাদের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় দুর্যোগ মোকাবেলায় তাদের অবকাঠামো, প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি ও গবেষণা কার্যক্রম সবার ওপরে। কাজেই ভয় কিসের? কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেসব সুবিধা তো কাজে লাগাতে হবে এবং সঠিক সময়মতো দ্রুত কাজে লাগাতে হবে সংঘবদ্ধভাবে, যেমন করেছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া।
ট্রাম্পের সে বিচক্ষণতা ছিল না। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে। ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্য আছে—অতি আত্মবিশ্বাস পতনের কারণ, তা দুর্যোগ-দুর্ভোগেও হতে পারে। তাই অনাক্রম্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিপুলসংখ্যায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সর্বাধিক আক্রান্তের দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এর মধ্যে ঘনবসতির নিউ ইয়র্ক খারাপ অবস্থায়।
এখন করোনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় লড়াইটা চালাতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে—প্রকৃতির পরিহাস, নাকি রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার খেসারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, এ খেসারত তো ট্রাম্প বা তাঁর অফিস দেবে না, দেবে নিরপরাধ মার্কিন নাগরিক। হয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অথবা তাতে মৃত্যুবরণ করে।
এর দায় কার, ভুলটা কার? বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রশাসনের, সুনির্দিষ্টভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের, যিনি সব কিছুর নিয়ন্তা। প্রথম সংক্রমণের পর বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানোর ব্যবধান প্রায় মাস দুই—যথেষ্ট সময় হাতে ছিল শাসক মহোদয়ের। এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি নির্বিকার বসে ছিলেন দ্রুত সব সুযোগ-সুবিধার সর্বাধিক ব্যবহার না করে? তিনি কি ভেবেছিলেন তাঁর ভয়ে করোনাভাইরাস আর দুপা এগোবে না? অবস্থাটা মনে হয় যেন ইংল্যান্ডের একদা রাজা ক্যানিউটের মতো।
কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। তাই সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষাধিক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কত জন মারা যাবে কে জানে। বিস্ময়কর লাগছে, ট্রাম্পের এ উদাসীনতা নিয়ে গণমাধ্যমে জোরালো প্রতিবাদের অভাব। শক্তিমান সংবাদমাধ্যম, করপোরেট হাউসগুলোও প্রায় তেমনই। মার্কিন জনগণের সমস্যা নিয়ে যারা সদা সরগরম, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ ভূমিকা নিয়ে জোরালো প্রতিবাদে সোচ্চার নয় কেন?
যে মুহূর্তে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করা দরকার ছিল, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, জনগণের করোনা আক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে করণীয় সম্পর্কে ভাবেননি। এক মার্কিন লেখকের মতে, ভবিষ্যৎ ইতিহাস এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করবে।
মার্কিনদের হিসাব-নিকাশের রকমসকমই আলাদা। আমাদের অভিযোগ : এই যে দেড় লক্ষাধিক মার্কিন নাগরিক করোনায় আক্রান্ত, তাদের মধ্যে যারা মারা যাবে তাদের পরিবার কি ট্রাম্পকে ক্ষমা করবে কিংবা ক্ষমা করবে ইতিহাস জনগণের সুরক্ষার জন্য নির্বাচনে জয়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে?
একটি খবরে প্রকাশ, এখনো করোনা-প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনায় উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপকরণ, প্রযুক্তি, অবকাঠামো ইত্যাদি কোনো কিছুরই অভাব নেই। শুধু দরকার সঠিক নির্দেশ ও সুদক্ষ কর্মব্যবস্থাপনা।
কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকার ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন মার্কিন লেখক মাইকেল ডি. অ্যান্টোনিও বেশ কড়া ভাষায়। তিনি ট্রাম্প সম্পর্কে এ বিষয়ে আরো লিখেছেন : ‘তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতিটি মুহূর্তের চুলচেরা হিসাব করবে ইতিহাস।’ তাঁর মনে হয়, ‘ট্রাম্পকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ইতিহাস।’ একজন বৃহৎ ব্যবসায়ী একটি বৃহৎ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণেই কি এ অবস্থা?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়বে, সেই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও। আমাদের প্রত্যাশা, এরই মধ্যে ট্রাম্পের বোধোদয় ঘটবে এবং ব্যাপক সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় জনগণের দুর্ভোগ হ্রাস পাবে। একই প্রত্যাশা ইতালি, স্পেন ও আক্রান্ত দেশগুলো সম্পর্কে। আর ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী