করোনাভাইরাসের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন। ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে এসব শিক্ষার্থীর লেখাপড়া।
২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়েছে। তবে ঈদের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ২৫ এপ্রিলের পর স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় রোজার ছুটি নির্ধারিত আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চলছে অনির্দিষ্টকালের ছুটি। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রায় আড়াই মাস থাকছে লেখাপড়ার বাইরে।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ এপ্রিল নির্ধারিত থাকলেও শুরু করা যায়নি। ৫ মার্চ শেষ হয় এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা। ৬০ দিনে এ পরীক্ষার ফল প্রকাশের রীতি থাকলেও সব বোর্ড তা পারবে না বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মার্চ মাসে নির্ধারিত স্কুলগুলোর ক্লাস টেস্ট বাতিল হয়ে গেছে।
রোজার ছুটির আগে ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। তাও বাতিল করা হয়েছে। জুলাই মাসে মাধ্যমিক স্তরের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা নির্ধারিত আছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা কীভাবে নেয়া হবে সেটি এখন বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, একটা মানসিক চিন্তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতি। মানুষের চিন্তা এখন রুটি-রুজি ও স্বাস্থ্য। এ পরিস্থিতির শিকার শতভাগ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার।
টেলিভিশনে পাঠদান বা অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের লেকচারের ব্যবস্থা করা হলেও সব শিক্ষার্থী যে তা গ্রহণ করতে পারছে তা নয়। এ পাঠদানের ওপর নির্ভর করে শিক্ষার বিদ্যমান স্বাভাবিক পঞ্জি চালিয়ে নেয়ার মতো অবস্থা নেই।
তাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে নতুন করে শিক্ষাপঞ্জি তৈরির বিকল্প নেই। পাশাপাশি শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্যবই কতটুকু অবশিষ্ট সময়ে পড়ানো সম্ভব, সেটা মনে হয় বিবেচনা করতে হবে।
এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। আর সম্ভাব্য বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জি তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের ভাবনাও জানা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের এ পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে বিশ্ব অচল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
যদিও পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নিতে টেলিভিশনে ক্লাস কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী সুবিধা পাচ্ছে, আর ৬০ শতাংশ বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস শেষ করা সম্ভব নয়। নতুন করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে টেলিভিশনে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিক স্তরের পাঠদান চলছে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে। একই টিভিতে ৬ এপ্রিল থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও অনলাইনে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কোনো শিক্ষক চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কানেকটিভি ‘বিডিরেন’ ব্যবহার করে লেকচার দিতে পারছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমত দূরশিক্ষণ পদ্ধতির এ পাঠদানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউই অভ্যস্ত নয়। যে কারণে শিক্ষকের পাঠদান গতানুগতিকই রয়ে গেছে। পাশাপাশি আছে নানা দুর্বলতা। অপরদিকে শিক্ষকের একপক্ষীয় আলোচনায় আগ্রহ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকজন অভিভাবক জানান, তারা দু’একদিন টিভি ছেড়ে সন্তানকে পাঠ দেখিয়েছেন। এখন আর দেখাচ্ছেন না। আবার বেশ কয়েকজন বলেছেন, তারা দেখানো অব্যাহত রেখেছেন।
দেখা যাচ্ছে, টিভিতে যে অধ্যায় পড়ানো হচ্ছে, তার আগের কয়েকটি অধ্যায় এখনও পড়া হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা ধরতে পারছে না। অনেক সময় বোর্ডের লেখা বোঝাও যায় না। উপস্থাপনা অনেক দুর্বল। তবু কিছুটা হলেও উপকারে আসছে ক্লাসগুলো। কিন্তু এ পাঠের ওপর ভিত্তি করে স্কুল খুলেই পরীক্ষা নেয়া ঠিক হবে না।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের এখনকার অগ্রাধিকার হচ্ছে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হলে ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করে দেয়া।
তবে ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায়, সেই চিন্তা আমরা ইতোমধ্যে করেছি। আমাদের হাতে কয়েকটি বিকল্প আছে। করোনা পরবর্তীকালে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে ইউজিসির অনলাইনে লেকচার দেয়ার আহ্বানেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তেমন একটা সাড়া মেলেনি। যদিও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, দুর্যোগকালীন সব শিক্ষার্থী মানসিক পীড়নে আছে। অনেকে জনসেবামূলক কাজে ব্যস্ত। তাই এটি এখন কার্যকর হবে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, আমাদের এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার হচ্ছে মহামারী মোকাবেলা। আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী দেশ-জাতির সেবায় নিয়োজিত হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে লেখাপড়ার চেয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা জরুরি। দুর্যোগ শেষ হলে আমরা লেখাপড়ার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার করণীয় নির্ধারণ করব।
এদিকে অনলাইনে পাঠদানের আহ্বানের সুযোগকে অপব্যবহার করতে শুরু করেছিল কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার নামে পরীক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষার্থী ভর্তি করছিল। ইউজিসি কঠোর ভাষায় পরীক্ষা ও ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, সাধারণ ছুটিকালে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে বিডিরেনের মাধ্যমে শিক্ষকদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তবে এটা বাধ্যতামূলক কিছু নয়। তিনি বলেন, সবাইকে মনে রাখতে হবে এটা দুর্যোগকাল। সেটা মাথায় রেখেই সংশ্লিষ্টদের চলতে হবে।