প্রসঙ্গ: যুবায়ের আহমেদ আনসারির জানাজা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যখন সারাদেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ইসলামি উপদলনেতা মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারির মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত জানায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া লাখো মানুষের সমাগম ঘটানো নিঃসন্দেহে একটি গর্হিত কাজ বলে আমি মনে করি। তবে এই জানাজাকে কেন্দ্র করে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিরুদ্ধে একটি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমার কিছু বলার আছে।

প্রথমত জানাজার নামাজ আদায় করা একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও অনুশাসন। এটি প্রতিপালন করা ফরজে কেফায়া। সমাজের ৫-১০ জন লোক আদায় করলেই পুরো সমাজের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা কোভিড-১৯ আতঙ্কের মধ্যে সরকারি বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতার জানায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লাখো মানুষের অংশগ্রহণ করতে। এই ঘটনাটি আমিসহ সারাদেশের সচেতন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। মহামারির মধ্যে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষ থেকে লকডাউন ভঙ্গ করে এই ধরনের গণজমায়েতের আয়োজন সীমালঙ্ঘনের শামিল এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকও বটে।

কিন্তু এই ঘটনার জন্য সেখানের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা পুরো জনপদের মানুষকে দায়ী করার প্রবণতাও একধরনের মূর্খতা। কেননা মবে প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের তেমন কিছুই করার থাকে না। মূলত এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতির চেয়ে তথাকথিত ধর্মীয় আবেগ বেশি কাজ করে। যদিও অধিকাংশ বিষয়ের সাথে ধর্মের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তাছাড়া যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি আমার নির্বাচনী এলাকাও না। তবে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর কেউ অযৌক্তিকভাবে কিছু চাপানোর অপপ্রয়াস চালালে সেই জেলার বাসিন্দা হিসেবে আমি চুপ থাকতে পারি না।

একথা সত্য যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শনিবার তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণেচ্ছু মানুষদেরকে যদি প্রশাসন বাঁধা দিত তাহলে সেখানে প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটত। তখন ঐ প্রাণহানির ঘটনার দায়-দায়িত্ব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াকর্মীরা কী গ্রহণ করতেন?। নিশ্চয় করতেন না। বরং তারা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ওপরই দায় চাপাতেন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যখন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাণ্ডব চালিয়েছিল তখন কী তাঁরা এর প্রতিবাদ করছিলেন?, করেননি। তখন যদি ঐসব অপরাধের বিরুদ্ধে মিডিয়া সোচ্চার হতো তাহলে হয়তো শনিবারের ঘটনাটি ঘটতো না।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমরা সবাই ইলেকট্রনিক, টেলিভিশন ও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সবসময় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু তা সারাদেশে কতটুকু কার্যকর করতে পেরেছি? আমরা কী সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছি?। যখন সরকারি ছুটিতে পোশাক শ্রমিকরা যখন ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটছিল কিংবা এবং পুনরায় ঢাকামুখী হয়েছিল তখন কী তাদের আটকাতে পেরেছি?, পারিনি। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া না সমগ্র দেশের চিত্রই এ ধরনের । তাই তো লক্ষীপুরে করোনায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করে মোনাজাতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এই জেলায় সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিট্রিশ বিরোধী বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম বাঙালি ব্যারিস্টার আব্দুর রসূল, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কবি আল মাহমুদসহ অসংখ্য কৃতিসন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্যাস দ্বারা সারাদেশের ৪০ ভাগ চাহিদা পূরণ করা হয়। অথচ একজনের জানাজাকে কেন্দ্র করে সোস্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত কিছু সংস্কৃতি ও মিডিয়াকর্মীকে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দেখেছি।

তাদের মধ্যে মার্জুক রাসেল নামে একজন তথাকথিত কবি ও নাট্যকার তার ফেসবুক পেইজে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে গালি দিয়ে লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে কার্যকরী ছয় মাসের জন্য লকডাউন করা হোক। এই ছয়মাস ব্রাক্ষনবাড়িয়ার বিদ্যুৎ বন্ধ করে পুরো দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। ততোদিনে তাদের.….।’ আমি মনে করি তিনি যদি জানতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ও সার দেশের মোট ৩৫-৪০% চাহিদা পূরণ করে তাহলে হয়তো এটি লিখতেন না। যদিও গত ১৩ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যে তার জেলায় মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে সংঘর্ষে যুবক নিহত হওয়ার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

এছাড়া জ.ই.মামুনের মতো একজন দায়িত্বশীল (তথাকথিত দায়িত্বশীল) মিডিয়াকর্মীকেও দেখলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে গালি দিতে। অথচ আমরা দেখেছি তার জেলার সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি ছেলেকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা ও লকডাউনের মধ্যে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটিয়ে মৃত ব্যক্তির জানাজা অনুষ্ঠিত হতে । এ ধরণের অপরাধ শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয় দেশের সবজায়গায়ই প্রতিনিয়ত ঘটছে। এসব মূলত সামাজিক অজ্ঞতারই ফসল। আমাদেরকে এসব থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেই পথটি হচ্ছে সকল ধর্মান্ধতা ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে