আংশিক লকডাউন প্রত্যাহার ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করুন

ডঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম

ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম
ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম। ফাইল ছবি

ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে এক কৃষকের জবানবন্দি। জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কার প্রাপ্ত এই কৃষক আহাজারি করে তাঁর দূর্ভোগ প্রকাশ করছেন। বঙ্গবন্ধু পুরষ্কারপ্রাপ্ত গাইবান্ধার এই আদর্শ চাষী, তাঁর সবজি ক্ষেতের শত শত মন সবজি বিক্রি করতে না পেরে রাগে-দুঃখে, অভিমানে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যার অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন। তাঁর মতে, তিনি শুনেছেন ঢাকায় করলা, পটল, বেগুন আর টমেটোর কেজি যেখানে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, সেখানে এই একই সবজি তাঁকে বিক্রি করতে হচ্ছে ২ টাকা পাইকারী আর ৩ টাকা খুচরা দরে। তাও আবার, সেনা-পুলিশের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে কোনমতে যদি বাজারে নেয়া যায়। প্রায়শঃই এক্ষত্রে পথে হয়রানি তথা ‘দৌড়ানি’ খেয়ে পালাতে হচ্ছে। অবশেষে তা গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা এবং গরুরও অরুচি ধরে যাওয়া, ইত্যাদি।

এই কৃষকের আহাজারির সাথে এবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের তুলনা করা যাক। তিনি চান যে এক চিলতে জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কৃষির জন্য তিনি দিয়েছেন প্রণোদনা প্যাকেজ। আর যাই হোক তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তিনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিচ্ছেন, যাতে কেউ অন্ততঃ কেউ না খেয়ে না মরে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তা পরে, এখন বাঁচা-মরা বড় প্রশ্ন।কিন্তু এটি বাস্তবায়নের জন্য তাঁর মন্ত্রী আছেন, এবং কৃষিমন্ত্রী স্বয়ং একজন কৃষিবিদ। যদি তাই হয়, তাহলে এই অব্যাবস্থাপনা কেন ?

universel cardiac hospital

সেই কৃষকটি তাঁর অতি সাধারন ‘কমন সেন্স’ থেকেই এই সমস্যার সমাধান সরকার কিভাবে করতে পারতেন তাঁরও বর্ণনা দিয়েছেন। সরকার নিজ তত্ত্বাবধানে কিংবা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশেষ ব্যাবস্থায় যদি এই সবজিগুলি মোটামুটি ন্যয্য দামে কিনে নিয়ে তা বড় শহরগুলিতে সরবরাহ করতে পারতেন তাহলে, উভয় সম্প্রদায়ই উপকৃত হত। ঢাকাবাসী কম দামে সবজি পেত, কৃষক ন্যায্য দাম আর সরকারও খরচ পুষিয়ে নিতে পারত। অর্থাৎ, কৃষকের কাছ থেকে ২০ টাকা দরে কিনে ঢাকায় এনে ৪০ টাকা আর সর্বসাধারনের কাছে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করলে সব কূল রক্ষা পেত। এটা কি অসম্ভব ছিল। আমার মনে হয় না। দেশ এই মুহূর্তে একটি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে – সম্ভবতঃ শতাব্দিকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। সেনাবাহিনীর সেবা নেবার এটাই তো প্রকৃষ্ট সময়।

শুধু কি শাক-সব্জি – ডিম, দুধ, মাছ, মুরগী এমন কি ফুলের বাজারও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস কিংবা স্বাধীনতাদিবসে ফুল বিক্রি করতে না পারায়, শুধু এই সেক্টরেইনা কি ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ! উৎপাদন খরচের চেয়ে কমে বিক্রি করতে হচ্ছে ডিম, দুধ আর মুরগী। নষ্টও হচ্ছে। অথচ এই মহাক্রান্তিকালে এক টুকরো খাবার, অনেকের কাছেই দুর্লভ, অমৃতসম। আর অন্যদিকে কিনা তা পঁচে-গলে নষ্ট হচ্ছে ! এই করোনা কালে, ডাক্তারদের একটি উপদেশ হচ্ছে, ভাল খাবার খান যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকে। আর এ ক্ষেত্রে শাক-সব্জি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ – এর চাইতে আর ভাল কিছু কি হতে পারে ?বোরো ধানের উত্তোলন নিয়ে মন্ত্রী আজকাল কথা বলছেন। অর্থাৎ ধানের উৎপাদন নিয়ে আমরা চিন্তিত। অথচ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী শাক-সব্জি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ সংরক্ষন তথা সরবরাহের একটা ব্যবস্থা করতে পারছি না কেন ?

সবচেয়েবড়কথাহচ্ছে, এইলকডাউনটিকতদিনচলবেবলেসরকারভাবছে। আরএকমাস ? বিশ্ব পরিস্থিতিবিবেচনায়তামনেহচ্ছেনা ।বরং,তাআরওঅনেকদীর্ঘায়িতহতেযাচ্ছেনিশ্চিত। বিজ্ঞানীদের পাশাপাশিধর্মগুরুকিংবা পরিবেশবিদরাও এই বিপর্যয়ের ব্যখ্যা দিচ্ছেন তাঁদের মত করে। কারও কাছ থেকেই তেমন আশার বাণী শোনা যাচ্ছে না। পাপে নিমজ্জিত মানব জাতি, তাই স্রষ্টার কাছ থেকে এ এক অভিশাপ !ধর্মগুরুদের ঠিক এমনই দাবি। বোমায় নিহত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে নিরপরাধ মানুষ, ধনী আর গরীবের ব্যাপক বৈষম্য সর্বব্যাপী।সহসা মানব জাতির এ থেকে নিবৃত হবার কোন লক্ষন আছে বলে মনে হয় না !সুতরাং, এবার স্রষ্টার রোষে এমন কোন ব্যধি যা ধনী-গরীবের ব্যবধান বুঝে না ! পরিবেশবিদেরা বলছেন একে লাগামহীন পরিবেশ দূষণের প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃতির প্রতিশোধ। আসলে, জীবন ধারনের মৌলিক উপাদান যথাঃ বায়ু আর পানি আমরা যেভাবে দুষিত করে চলছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর রোগ-বালাই এ শ’খানেক বছরের মধ্যে এই মানুষ্য প্রজাতি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবার কথা!

এসবকিছু বাদ দিলে, খোদ বিজ্ঞান কি বলে ? ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে লাগবে কম করে হলে আরও এক বছর। ডিসেম্বরের আগে তো না ই! প্রতিষেধক ঔষুধের ব্যাপারেও তেমন কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না! দেখা যাবেই বা কিভাবে – নিউটন, আইনষ্টাইনের মত সেই সতিকারের বিজ্ঞানী আজ আর তৈরি হচ্ছে কৈ– নেই আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং, লুই পাস্তুর বা ইবনে সিনার মত বিজ্ঞ চিকিৎসা বিজ্ঞানীও সম্ভবতঃ। বৈজ্ঞানিক গবেষনাও এখন চলে লাভ-লোকসান হিসাব কষে। মাসে মাসে মোবাইল ফোনের নতুন নতুন মডেল আর অত্যাধুনিক গাড়ির বাহার –পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের অসুস্থ প্রতিযোগীতায় এসবের পেছনে অনেক বেশি সময় ও মেধা ব্যয়িত হচ্ছে আজকাল বিজ্ঞানী ও প্রজুক্তিবিদদের। কেননা এতে লাভ অনেক বেশী। আবার শক্তির মহড়া দিতে অত্যাধুনিক মরনাস্ত্র তৈরীতে উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত আরেক গোষ্ঠী। ক্যান্সার, এইচাইভি বাদ দিলাম, সাধারন এলার্জির কোন স্থায়ী সমধানাও তো নাই। সাময়িক চিকিৎসা চলছে এখনও সেই আদিকালের ‘হিস্টাসিন’ জাতীয় ঔষুধ দিয়েই। অন্যথায়, ঠিক একশ বছর আগের সেই ‘স্প্যনিশ ফ্লু’ এর লকডাউন আর বছরব্যায়ী ভ্যাকসিন পরকল্পনা, একবিংশ শতাব্দিতে এসে কেন সেই একই রয়ে গেল ?

এহেন পরিস্থিতিতে মোটামুটি ধরে নিতে পারেন যে আগামি ডিসেম্বরের আগে কোন সুখবর নাই। তাই যদি হয়, তাহলে আরও ৭-৮ মাস কি ঘরে বসে কাটিয়ে দেবার মত সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে কি না ? কেননা তখন করোনার চাইতে ক্ষুধা অনেক বেশি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। সাথে যোগ হতে পারে সামাজিক অস্থিরতা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। ভাগ্য ভাল যে, সুজলা-সুফলা এই দেশ আর যাই হোক নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ফলে এই খাদ্য উৎপাদন আর বিতরন ব্যাবস্থাটি নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে পারলে অন্ততঃ খেয়ে পড়ে কোনরকমে এই ক্রান্তিকালটি পার করা যাবে হয়তোবা ! ফলে ডিম, দুধ আর টমেটোর মত পুষ্টিকর খাদ্য কোনভাবেই নষ্ট হতে দেয়া কাম্য নয়।

একইভাবে, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত গার্মেন্টস শিল্পকে এভাবে লম্বা সময় বসিয়ে রাখাও খুব একটা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। বরং তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার তথা সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করে হলেও এ শিল্পের শ্রমিকদের কাজ শুরু করতে দেয়া উচিত। শুধু টাকা বিলি নয়, কিছু টাকা বিশেষ ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সরকারকে এখানে খরচ করতে হবে, যাতে করে সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়ে এই গার্মেন্টস কর্মীরা কাজ করতে সক্ষম হয়। প্রয়োজনে ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যেই তাঁদের অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যাবস্থাও করা যেতে পারে। বিশেষ চিকিৎসা সহায়তার ব্যাবস্থাও।

অন্যদিকে, সরকার প্রণোদনারজন্য অনেক সেক্টরের কথা বললেও, স্বাস্থ্য খাতে কিভাবে প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা করছে এটা স্পষ্ট নয়। যদি টেষ্টের পরিমান বাড়ানো যায়, চিকিৎসা সুবিধা উন্নততর ও সহজলভ্য হয়, তাহলে আংশিক লকডাউন প্রত্যাহার করে কাজ শুরু করে দেয়ার মত ঝুঁকি নেয়া যেতেই পারে। আর এক্ষত্রে এই মুহূর্তে যদি স্বাস্থ্য খাতে দশগুণ বেশি খরচ করতে হয় তাও করা উচিত। অর্থনীতি প্রতিদিন যে পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তাতে করে এ টাকে খরচ এখানে কিছুই না! ইনস্যুরেন্সের কথা বলা হলেও, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ডাক্তাররা করোনা রোগী চিকিৎসা করছে, তাঁদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন ঝুঁকি ভাতার ঘোষণাটিও কেন দেয়া হল না। বরং ‘সাস্পেনসন’ এর মত হুমকির শিকার হচ্ছেন তাঁরা। যতদুর জানি, যুদ্ধে গেলে একজন সৈনিক যুদ্ধ ভাতা পেয়ে থাকে। আর আজকের এই করোনা যুদ্ধে অগ্রসৈনিক ডাক্তাররা যত ভাল কাজ করবে তাঁর উপর নির্ভর করছে, এই দূর্যোগ থেকে কত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেতে পারব বা অন্ততঃপক্ষে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। সুতরাং, অন্ততঃ সুস্পষ্টভাবে তাঁদের প্রণোদনার বিষটি আরও যুক্তিসংগত পর্যায়ে করা উচিত।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, আমার মনে হয় সরকারকে শুধু লকডাউন, টাকা বিলি আর ত্রান ছিটিয়ে ধীর্ঘসময়ব্যাপী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, বরং সুদূরপ্রসারী বহুমূখী সমাধানের পথ খোঁজা উচিত।তাছাড়া সারাদেশে নিচ্ছিদ্র লকডাউন আসলে সম্ভবও হচ্ছে না। এই মুহূর্তে পরকল্পিতভাবে যা করা উচিত তা হচ্ছে কৃষি খাতকে সচল করা, খাদ্য-দ্রব্য সরবরাহ ব্যবস্থাটি নিরবিচ্ছিন্ন করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটির ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে আনা এবং গার্মেন্টস শিল্পটিকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে চালু করা । আর এ সবের মাধ্যমে লকডাউন থেকে বের হতে হবেধীরে ধীরে।

ডঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম; অধ্যাপক, সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে