ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে আগামী ১০ মে থেকে শপিংমল ও দোকানপাট খুলে দেয়া হবে বলে সরকারিভাবে যে ঘোষণা এসেছে, তাতে সামনের দিনগুলো ঘিরে যেন অশনিসংকেত শুনতে পাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এ ধরনের ঘোষণায় মানুষের মনে লকডাউন শিথিল হচ্ছে বলে বার্তা যাচ্ছে। যদি ঘোষণা অনুসারে শপিংমল ও দোকানপাট খোলা হয়, তবে আগামী দুই সপ্তাহ পর দেশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
শপিংমল ও দোকানপাট খোলার ব্যাপারে সরকারের ওই ঘোষণার পর মত ও পথের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এ আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন।
এর আগে গত সোমবার (৪ মে) সরকারি এক আদেশে চলমান ছুটি ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ওই আদেশে বলা হয়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দোকান ও শপিংমল আগামী ১০ মে থেকে খুলবে। তবে তা বিকেল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মত ও পথকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে আগামী ১০ মার্চ থেকে শপিংমল ও দোকানপাট খুলবে, সরকারি এমন ঘোষণা সামনের দিনগুলো ঘিরে করোনার ভয়াবহ অশনিসংকেত দিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় মানুষের মনে লকডাউন শিথিল হচ্ছে বলে মানসিকতা তৈরি করছে। ঈদ সামনে রেখে দোকানপাট খোলা হচ্ছে এমন ঘোষণা না দিয়ে, জরুরি প্রয়োজনে কেনাকাটা করার জন্য সীমিত আকারে দোকানপাট খোলা হচ্ছে এমন ঘোষণায় হয়তো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা ঠেকানো যেত। এছাড়া ঢালাওভাবে গার্মেন্টস ও কলকারখানা খুলতে শুরু করায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, চলমান লকডাউনকে আরও জোরদার করার মাধ্যমে এবং নিম্নআয়ের মানুষ, বিশেষত বস্তির বাসিন্দাদের সামাজিক সহায়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সময় এখনো আছে। এক্ষেত্রে বস্তির বাসিন্দাদের জন্য স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার কিংবা নির্মাণাধীন ভবনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে আগামী দুই সপ্তাহ পর রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। এতো বিপুলসংখ্যক করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেয়াও দুরূহ হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন মত ও পথকে বলেন, রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিতে এমন পরিবার রয়েছে, যেখানে একটি ঘরে একাধিক সদস্য বাস করেন, তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা দুষ্কর। রাতের বেলা কোনোভাবে ঘুমিয়ে কিংবা জেগে কাটিয়ে দিলেও দিনের বেলা তারা বাইরে এসে আড্ডা মারছেন। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেছেন, তাদের ঘরে নারী ও বাচ্চা রয়েছে। দিনের বেলা ঘরের মধ্যেই চুলা জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। এসব কারণে তারা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। তাদের অনেকেই মৃদু উপসর্গ নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করার ফলে তারা অন্যদেরও ঝুঁকি তৈরি করছেন। বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের ঝুঁকিতে ফেলছেন।
তিনি বলেন, সারাদেশেই বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে র্যাপিড রেসপন্স টিম রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন বস্তি এলাকায় অসংখ্য এনজিও কাজ করে। এখন সময় এসেছে সরকারি এবং বেসরকারি কর্তৃপক্ষ- সবার মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে কাজ করার। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে লোকজনকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা এবং খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানরা এগিয়ে এলে করোনার সংক্রমণ সীমিত পর্যায়ে রাখা যাবে।
‘বর্তমানে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি। এসব এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন করে ব্যাপক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। নমুনা পরীক্ষার চেয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বেশি প্রয়োজন।’
ডা. মুশতাক হোসেন আরও বলেন, সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে বললেও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তা সম্ভব নয়। ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে পরীক্ষা করে করোনার মৃদু লক্ষণ বা উপসর্গ পাওয়া গেলে তাদের কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। এজন্য পৃথক স্থানে কমিউনিটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার কিংবা ফাঁকা কোনো ভবন কমিউনিটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে দুর্যোগ সময়ের জন্য ভলান্টিয়ার নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। তবেই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত বস্তিতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার এখন উভয় সংকটে রয়েছে। নিম্নআয়ের হতদরিদ্র মানুষের কাছে সামাজিক সহায়তা পৌঁছে দিতে না পারলে তারা অনাহারে মারা যাবে, আবার তাদের সহায়তা না দিয়ে অবাধে চলাফেরা করতে দিলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। এক্ষেত্রে সরকারকে নিম্নআয়ের ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সামাজিক এবং স্বাস্থ্য সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। সরকার শুধু নিয়ম মেনে চলার কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে ৫ মে পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু ধারণা করা যায়, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা না হওয়ায় এ সংখ্যা কম। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও ১০-১২গুণ বেশি।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় করোনা সংক্রমণ রোধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার চেয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানের নামে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্যাকেজ নিশ্চিত করতে না পারলে এবং অব্যাহতভাবে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান দুরূহ হয়ে পড়বে। তখন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকবে। এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে না চাইলে সামাজিক ও স্বাস্থ্য প্যাকেজ নিশ্চিত করার পাশাপাশি লকডাউন আরও কিছুদিন জোরদার করতে হবে- বলেন ওই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মঙ্গলবারের (৫ মে) সর্বশেষ বুলেটিন অনুসারে, দেশে ১০ হাজার ৯২৯ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায়ই আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৭৮৬ জন, যা এখন পর্যন্ত একদিনে শনাক্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা। মারা গেছেন ১৮৩ জন। আর সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৪০৩ জন।