দৃষ্টান্ত গড়লেন ‘করোনাযোদ্ধা’ ডা. মশিউর

মত ও পথ প্রতিবেদক

ডা. মশিউর রহমান

অনন্য দৃষ্টান্ত গড়লেন চিকিৎসক মশিউর রহমান। করোনার মহামারি থেকে বাঁচতে সবাই যেখানে নিজেকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছেন, তখন ব্যতিক্রমী নজির গড়লেন তিনি। নিজে আবেদন করে বদলি হয়ে এলেন করোনাদুর্গত এলাকায়, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে।

ডা. মশিউর রহমান নিরাপদেই ছিলেন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে সহকারী সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বদলির আবেদন করেন তিনি। বলেন, নারায়ণগঞ্জ কিংবা গাজীপুরের মতো করোনা প্রাদুর্ভাব বেশি এমন এলাকায় যেকোনো হাসপাতালে বদলি হয়ে যেতে চান তিনি। সেই অনুযায়ী তাকে সিরাজগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ সদরের ৩০০ শয্যা হাসপাতালে বদলি করা হয়।

ডা. মশিউর রহমানের ভাষায়, দেশের মানুষের সেবার জন্য চিকিৎসা পেশায় এসেছেন। এই দুর্যোগে অনেক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এতে চিকিৎসক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই তিনি মনে করেছেন নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতকতা থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাই জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও করোনা আক্রান্তদের সেবায় এগিয়ে এসেছেন।

গত ১৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর আবেদন করে ডা. মশিউর রহমান। এতে তিনি বলেন, ‘দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য আইসোলেশন সেন্টার ও করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলোতে সরকারি ডাক্তারের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় আমি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে করোনা টিমে বদলি হয়ে করোনা রোগীদের সেবা করতে ইচ্ছুক।’

তার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা হাসপাতালে বদলি করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি যেই উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করছি সেখানে করোনা রোগী নেই। প্রতিদিনই আমাদের চিকিৎসকরা সংক্রমিত হচ্ছেন। পর্যাপ্ত জনবলের অভাব আছে। চিকিৎসকরা প্রতিদিনই সংক্রমিত হওয়ায় নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই এই আবেদন করেছি।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরি করি। সরকার আমাকে যেখানে, যেক্ষেত্রে কাজ করতে বলবে সেখানে কাজ করব। আর যেখানে কাজ নেই সেখানে বসে বসে সময় পার করা যায়। কিন্তু এতে মনুষ্যত্ব থাকে না। দিন শেষে আমি দেখতে চাই আমার শ্রমে রাষ্ট্র আর এই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক যারা, তাদের কতটুকু কাজ করতে পারলাম। এখন আমি শান্তি বোধ করছি। এটা এমন কিছু নয়, শুধু নিজের মুনষ্যত্বকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছি।’

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যেখানে দিনকে দিন বাড়ছে সেখানে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মরতে তো হবেই। মরবো যখন ভালো পথেই মরি। মানুষের সেবা করেই মরি। আমার নানা সুবেদার হাবিবুর রহমান (বীর উত্তম) দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ৪৬ বছর পঙ্গুতের সঙ্গে লড়েছেন। নানার কাছ থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারি নি সংগত কারণেই। তাই ভেবেছি দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে করোনার সঙ্গে যুদ্ধটা চালিয়ে যাই।’ বদলি হওয়ার আবেদনেও উল্লেখ আছে নানার বীরত্বের কথা।

ডা. মশিউর রহমানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দিতে। সাবেক সরকারি চাকুরে (বিজিবি’র ক্লার্ক) মো. বজলুর রহমান ও গৃহিনী শিরিনা আক্তার এর বড় ছেলে তিনি। সংসারে বাবা, মা ছাড়াও দুই ভাই ও এক বোন আছেন। মশিউর রহমান ৩৯তম বিসিএস ক্যাডার। এক ভাই আইন পেশায় জড়িত, আরেক ভাই পড়াশুনা করছেন। একমাত্র বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মশিউর রহমানের নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামে। তাঁর নানা হাবিবুর রহমান (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরসেনানী। ঢাকার নিউ মার্কেটে হাবিবুর রহমানের নামে একটি গেইট রয়েছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে