গত ২১ এপ্রিল ‘প্রথম আলো’ তে প্রকাশিত ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেঠিক প্রতিক্রিয়া ও ‘অনুকরণের’ ভয়’ প্রবন্ধটি পড়লাম। সুন্দর লেখার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মস্থান বিধায় এ নিয়ে ফেইসবুকে কৌতুকগুলি মনোযোগ দিয়েই দেখছিলাম, তবে এই প্রথম কোন সিরিয়াস লেখা পড়লাম। লেখক হেলাল মহিউদ্দীন নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং আমার সহকর্মী। তবে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন, সম্ভবতঃ কয়েকমাস, বিধায় দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বহুদিন বিদেশ ছিলেন বলেই কিনা, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিক পুরোপুরি অবগত আছেন কিনা নিশ্চিত নই। আর এজন্যই, তিনি বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছেন হয়তোবা। তবে, ফেইসবুকে কোন সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে মাতামাতি বাংলাদেশে নতুন নয়। এটি আমাদের প্রাত্যহিক একঘেঁয়ে জীবনে নির্মল বিনোদনের একটি বড় উপায়। এধরনের বিনোদনের ঘটনা হররোজ এখানে চলছে এবং কর্মহীন কিছু লোক খেয়ে না খেয়ে এগুলির পেছনে লেগে আছেন আর একের পর এক কোলাজ বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে পোস্ট দিচ্ছেন।
ফলে এধরনের ছোটখাট ঘটনার সাথে নৃবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ কিংবা তার চেয়েও ততোধিক জটিল বাংলা অনুবাদ ‘স্ব-সংস্কৃতিশ্লাঘা’ যে খুব একটা সম্পর্কযুক্ত, আমার মনে হয় না। বরং তা অনেকটা ‘মশা মারতে কামান দাগা’ আর সেই ‘অর্বাচীন’ ফেইসবুক ‘মশকরা’ কারীদের কিছুটা ‘আশকারা’ দেয়ার শামিল হবে বৈ কি। বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশে আঞ্চলিকতা বা ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ যে খুব একটা প্রকট, সেরকম কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে এক দেশ, এক ভাষা। প্রায় একই রকম গায়ের রং, চেহারা আর সংস্কৃতি। এ সমস্যা প্রকট হতে পারে ভারতের মত দেশে, যেটি শ’খানেকের মত ভাষা, সংস্কৃতি বা ধর্মের সংমিশ্রনে গঠিত – বিভিন্ন রং আর প্রজাতির মানুষ। আথবা ইমিগ্র্যান্ট সর্বস্ব আমেরিকা, কানাডা বা আস্ট্রেলিয়ার মত দেশে। কিংবা বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিতে-জাতিতে বা ধর্মে-ধর্মে বৈরিতার প্রেক্ষাপটে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও এক রাজ্যের সাথে আরেক রাজ্যের প্রতিযোগিতা মূলক কৌতুক যুদ্ধ সর্বজন বিদিত। যেমনঃ এক রাজ্য থেকে বেড়াতে গিয়ে অন্য রাজ্যের তরমুজের দোকানে তরমুজ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাচ্ছিল্য ভরে ক্রেতার বক্তব্য ‘এত ছোট তোমাদের রাজ্যের তরমুজ’। বিক্রেতা আরও এক কাঠি সরেস ‘দেখ, আঙ্গুরটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করো না, নষ্ট হয়ে যাবে’। তাহলে বুঝুন একবার, আঙ্গুরই যদি এত বড় হয়, তরমুজ কত বড়। মোক্ষম জবাব!
লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে উত্যক্তকারীরা যদি ‘এথনোসেন্ট্রিক ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র ধারক ধরে নিয়ে ‘আদার’ বা অন্যকে ‘নীচু সংস্কৃতির’ ধারক দেখানোর একধরনের চেষ্টায়’ ব্যপৃত হন, তাহলে একে আমি ‘আদার ব্যপারীর জাহাজের খবর নেয়ার’ মত ধৃষ্টতা বলেই গণ্য করব। কেননা, সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই উস্তাদ আলাউদ্দীনের জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে এই বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে গণ্য করা হত। সংগীতের তালিম নেয়ার জন্য সারা উপমহাদেশ থেকে বিদজ্ঞজনরা আসতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। অজস্র উঁচুমানের সংগীতজ্ঞ, কবি, সাহিত্যিক আর সাংবাদিকের জন্মস্থান এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম বাঙালি ব্যারিস্টার আব্দুর রসূল, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কবি আল মাহমুদসহ অসংখ্য কৃতিসন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন এখানে। বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ অনেক উঁচুমানের রাজনীতিবিদের জন্মও এখানে। এটা সর্বজনবিদিত যে, ব্রিটিশ আমল থেকেই, বাংলাদেশ যে কয়টি জেলা শিক্ষা দীক্ষায় সবচেয়ে আগ্রসর ছিলেন, তৎকালীন কুমিল্লা জেলা তার একটি, যার অন্তর্গত ছিল এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা। বলা হয়ে থাকে যে, পাকিস্তান আমল সি এস পি অফিসার এবং বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে সরকারের সর্বোচ্চ পদ ‘সচিব’ পর্যায়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিল কুমিল্লা, বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। কেবিনেট সচিব আকবর আলী খান বা সিদ্দিকুর রহমানের মত অজস্র জাঁদরেল সচিবরা এসেছেন এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। সেনপ্রধান জেনেরেল নাসিম থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার – জয় জয়কার এখনও সর্বক্ষেত্রে। ‘কোটা’ প্রথার খপ্পরে পরে স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে, সরকারি কর্মকর্তা পদে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হবার পরও শুধু মেধার বলে, বাংলাদেশের বাকী ৬৫ টি জেলার তুলনায় গড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক গুন বেশি। বেসরকারিতেও একই অনুপাতে।
নিন্দুকদের একটি গোষ্ঠী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন কৌতুক করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীও অবশ্য কম যাচ্ছেন না। তাঁদের ধারনা, সেক্ষেত্রে এটি হয়ে উঠতে পারে সিংগাপুরের মত। কেননা, দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস ফিল্ড তিতাস, সবচেয়ে বড় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা সার কারখানা জিয়া ফার্টিলাইজার এখানে অবস্থিত। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ, আব্দুল মোনেম লিমিটেড, ওরিয়ন গ্রুপ বা উত্তরা মটরস/ঊত্তারা গ্রুপের কর্নধাররা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। অর্থাৎ প্রথম দশটি বড় শিল্প গ্রুপের প্রায় পাঁচটি! যতদূর জানি, দেশে রেমিট্যান্স সরবরাহেও আছে এর গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা। বলা হয়ে থাকে, এখানকার গ্রামাঞ্চলে প্রতি ঘরে অন্ততঃ একজন বিদেশে আছেন।
তবে দুর্নামের বিষয়ও কিছু আছে বৈ কি ?এরা উগ্র প্রকৃতির ও মারামারি একটু বেশি করে। দেশের অন্যতম স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই কৃতি সন্তান বাংলাপিডিয়ার জনক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এ ব্যাপারে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছিলেন কোন এক বক্তৃতায়। কোন এক অনুষ্ঠানে তাকে বলতে শুনেছি যে, ব্রিটিশ রাজের অনেক নথিপত্রে নাকি এটা স্পষ্ট করেই বলা ছিল যে, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অঞ্চলের মানুষের গড়পরতা বুদ্ধি-শুদ্ধি বাংলাদেশের বাকী অংশের তুলনায় অনেক উন্নততর ছিল। তবে, নথিতে এটাও উল্লেখ্য ছিল যে, বৃহত্তর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অঞ্চলের মানুষ কিছুটা উগ্র ও অনিয়ন্ত্রিত, যাতে করে বাংলা অঞ্চলের সবচেয়ে জাঁদরেল কোন এসডিও বা মহকুমা প্রশাসককে বরাবরই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়োগ দেয়া হত। কথাটি একেবারে অসত্য না – ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষের এই দ্বৈত চরিত্রটি সম্ভবতঃ এখনও বিদ্যমান।
যাই হোক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে আবার ‘স্ব-সংস্কৃতিশ্লাঘা’ দোষে দুষ্ট হওয়া সমীচীন নয়। এটি একটি ছোট দেশ এবং দেশের অন্য যে কোন অঞ্চলেও যদি কোন পীর মারা যেত, আমি নিশ্চিত যে একই ঘটনা ঘটত হয়তোবা। যেমনঃ চরমোনাই এর পীর বা এনায়েতপুরী, ইত্যাদি। লকডাউন এর দোহাই দিয়ে লোক ঠেকানো যেত না। এটা আমাদের জাতীয় চরিত্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য আলাদা নয়। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সাথে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, এটাই নিয়ম। একটি অঞ্চলের মানুষকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের মত দেশে কোনভাবেই লকডাউন, পুরোপুরি কার্যকর করা যাবে না। আর এই করোনা যুদ্ধের সমাধান আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মাঝেই। এ যাত্রা করোনা থেকে বেঁচে উঠতে পারলে, আমি নিশ্চিত, বিশ্বব্যাপি মহামারী নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হবে গুরুত্ত্বের সাথে। আর সেক্ষেত্রে এখনকার মত এক বছরের পরিবর্তে এক মাসেই হয়তোবা ভ্যাকসিন বা ঔষুধ তৈরীর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে। আর এটাই হবে সমস্যাটির একমাত্র টেকসই সমাধান।
লেখক, ড. মোঃ সিরাজুল ইসলাম; অধ্যাপক, সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।