অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : প্রগতিশীল জীবনভাবনার কাণ্ডারি ।। সরকার আবদুল মান্নান

ফাইল ছবি

আনিসুজ্জামান- এই নামটি এখন আর একজন ব্যক্তির নাম নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম- মুক্তবুদ্ধির প্রতিষ্ঠান, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের প্রতিষ্ঠান, বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষার প্রতিষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর বিপুল কর্ম ও আদর্শের ঐতিহ্যে তিনি বাঙালি জীবনের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন, অনুস্মরণযোগ্য একটি আদর্শ হয়ে উঠেছেন যেখানে আমরা মুক্তির আনন্দ লাভ করি, ঔদার্যের মাহাত্ম্য লাভ করি।
যুগে যুগে এদেশে বহু চিন্তাশীল পণ্ডিতজনের আগমন ঘটেছে যাদের চিন্তার ফসল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা গ্রন্থে, নানা কর্মে। কিন্তু সেইসব চিন্তার সামাজিক উপযোগিতা আছে কতটা এবং আমাদের জাতিগত উৎকর্ষ সাধনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে- এ জিজ্ঞাসা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেননা বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থায় চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত সাহস, প্রজ্ঞা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা।
অনেকেই সত্য ও সুন্দরের পক্ষে, ন্যায়পরায়ণতা এবং জাতিগত ঐতিহ্য ও অগ্রগতির পক্ষে সাহস নিয়ে, অঙ্গীকার নিয়ে প্রত্যয়ের সঙ্গে অবস্থান নিতে পারেননি।
কিন্তু আনিসুজ্জামান সেই বিদ্বজ্জন, যিনি জীবন বাজি রেখে বাঙালি-জীবন ও আদর্শের পক্ষে লড়াই করছেন; মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রগতির পক্ষে লড়াই করছেন। আর এসবের মূলে আছে সামাজিক উপযোগিতা এবং প্রগতি।
এই দায়বোধ থেকেই ড. আনিসুজ্জামান তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জগতকে প্রসারিত করেছেন বিপুল বৈচিত্র্যে। একবার যদি তাঁর সেই গবেষণা ও দায়বোধের জগৎটি দেখে আসি তা হলে এই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানিকতার একটি পর্যায় অনুভব করা যাবে।
গবেষণাগ্রন্থ : মুসলিমমানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনির চৌধুরী (১৯৭৫), Social Aspect of Endogenous Creativity (1979), Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records (1981), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮), Creativity, Identity and Reality (1993), Identity, Religion and Recent History (1995), Cultural Pluralism (1993) আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮), আমার চোখে (১৯৯৯), বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩)ইত্যাদি।
বেশ কিছু বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করেছেন তিনি। যেমন অস্কার ওয়াইল্ডের An Ideal Husband এর বাংলা নাট্যরূপ দিয়েছেন আদর্শ স্বামী (১৯৮২), আলেক্সেই আরবুঝুবের An Old World Comedy বাংলা নাট্যরূপ দিয়েছেন পুরনো পালা (১৯৮৮)।
একক ও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। যেমন রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ (১৯৬৮), Culture and Thought (যৌথ, ১৯৮৩) মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১ম-৪র্থ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলা সাহেিত্যর ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (যৌথ, ১৯৮৭), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯০) স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯৯২), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৩), নজরুল রচনাবলী ১ – ৪ খণ্ড (যৌথ ১৯৯৩), SAARC: A People’s Perspective (১৯৯৩), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১৯৯৫), নারীর কথা ( যৌথ ১৯৯৪), ফতোয়া ( যৌথ ১৯৯৭), মধুদা (যৌথ ১৯৯৭) ইত্যাদি।
এই বিপুল কর্মযজ্ঞের ভিতর দিয়ে ড. আনিসুজ্জামান বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিচয় ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন; বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস ও বাঙালি জীবনের আদর্শ ও মূল্যবোধ গঠনে তাঁর ভূমিকা নির্ধারণ করেছেন; বহুত্ববাদী জীবনবোধ ও গণতান্ত্রিক আদর্শ বিনির্মাণে বিচিত্র জ্ঞানকাণ্ড কীভাবে ভূমিকা রেখেছে তার স্বরূপ তুলে ধরেছেন; বাংলা গদ্য ও গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করে তিনি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পটভূমি তুলে ধরেছেন; আমাদের জাতিসত্ত্বার ইতিহাসে যেসব গুণিজন অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের কর্ম ও সৃষ্টির জগৎ উন্মোচন করে আমাদের গর্বিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
এছাড়া আরও কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে যে তিনি কাজ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। অসাধারণ এক সহজাত ঔদার্যবোধ থেকে তিনি ভালোবাসেন এদেশকে, এ দেশের মানুষকে। ফলে অনিবার্যভাবেই তাঁর চিন্তা ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এদেশের মানুষ। আর এই অসাধারণ মনোগড়ন তিনি লাভ করেছেন পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তর সাধক হিসেবে।
তাঁর দাদা শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) ছিলেন বিখ্যাত লেখক। দাদা সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘১৮৮৮ সালে আবদুর রহিমের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘হজরত মুহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’ প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম নবীজীবনী রচনা করেন। চার শতাধিক পৃষ্ঠার এ বইতে তার ব্যাপক পাঠ এবং যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় আছে। বইটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ হয়েছিল, প্রতি সংস্করণেই তিনি পরিবর্তন-পরিবর্ধনকরেছেন।’ এই বইটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া তিনি মিহির ও সুধাকর এবং মোসলেম হিতৈষী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আনিসুজ্জামানের পিতা ডা. আবু তাহের মোহাম্মদ ছিলেন খ্যাতিমান হোমওিপ্যাথ চিকিৎসক। আর মা হাতেম তাই গ্রন্থের লেখক। এই অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয় থেকে স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় যে, ড. আনিসুজ্জানের অস্তিত্বের মধ্যেই আছে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনার গোপন এক ন্যায়সূত্র। বংশানুক্রমিক এই অভিজাত জীবনাকাক্সক্ষা তাঁর জীবনে এসে কতভাবে যে পল্লবিত হয়ে ওঠে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৫৮ সালে পিএইডি গবেষণায় বাংলাসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮) নিয়ে যে গবেষণা সমাপ্ত করেন তা আজ অবধি অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণাকর্ম হিসেবে পরিজিত হয়ে আছে। ১৯৬৪ সালে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। এই গ্রন্থ সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিম বাঙালি মনীষার প্রকৃতি গ্রন্থে লিখেছেন :
“অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর দুই যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত কালের বাঙালি মুসলিম সমাজের এবং বৃহত্তর ভারতীয় মুসলিম সমাজেরও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের যে তথ্যভিত্তিক বিবরণ লেখক সাহিত্য প্রসঙ্গে উপস্থিত করেছেন, তাতে তাঁর পুস্তকের প্রথম ভাগ মুসলিম সমাজের বিকাশের একটি মনোজ্ঞ সামাজিক বিশ্লেষণগ্রন্থে পরিণত হয়েছে।”
প্রায় প্রতিটি গবেষণাকর্মে আনিসুজ্জামান অসাধারণ এই প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত তিনি জ্ঞানের চর্চা করেছেন একটি উপযোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রগতিশীল সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে এবং নতুন জ্ঞানকাণ্ডের বিকাশে তাঁর এই গবেষণা আমাদের জীবনে প্রভূত ভূমিকা রেখে চলছে। আতা সরকার যথার্থই বলেছেন :
“আনিসুজ্জামান একনিষ্ঠ গবেষক। গবেষণায় তাঁর সৃজনশীলতা, পাণ্ডিত্য ও মৌলিকত্ব সর্বজনবিদিত। জনতার কাতারে মিশে যাওয়া আনিসুজ্জামানকে সবসময় দেখে বোঝা যায় না নিভৃত গবেষণায় তিনি কত গভীর অন্তর্গামী, নিপুণ বিশ্লেষক, প্রতিপাধ্য নির্ধারণে দক্ষ। তাঁর এই দুই ধরনের সত্ত্বাকে বিভাজিত করা সম্ভব নয়।”
এই পললঘটিত উর্বর সমভূমির অতি সহজ-সাধারণ মানুষগুলো আশ্রয়ের জন্য চিরকালই ব্যাকুল। তারা দেশের শুভবুদ্ধির মানুষ হিসেবে দেখতে চায় বুদ্ধিজীবীদের, যারা দেশের সঙ্কটে অভিবাবকের ভূমিকা গ্রহণ করে দেশকে রক্ষা করবেন সমূহ বিপদ থেকে এবং যারা স্বার্থের পিছনে হাঁটবেন না, যারা রাজনীতির লাভালাবের কথা ভাববেন না, যারা আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন না, যারা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবেন না, যারা কথায় ও কাজে ভিন্ন হবেন না, যারা কোনো মুখোশের আড়ালে অবস্থান করবেন না- এমন বুদ্ধিজীবীদের জন্য এ দেশের মানুষ প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এ দেশের খুব কম বুদ্ধিজীবীই এই মাহাত্ম্য অর্জন করতে পেরেছেন। ফলে বুদ্ধিজীবীদের সততার প্রশ্নে এ দেশের মানুষ বহুদিন ধরে ভাবিত। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সততার প্রশ্নে প্রশ্নাতীত। এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বিস্ময়কর সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে ভূমিকা রেখেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা যথার্থই বলেছেন যে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাদের প্রাণের মানুষ। প্রায়ত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকও যথার্থই বলেছিলেন, “আনিসকে ৬১ বছর ধরে চিনি। তিনি জাতির গর্ব, আমাদের গর্ব। বঙ্গজননী পঞ্চাশের দশকে রত্নগর্ভা হয়ে উঠেছিল। দেশ অনেক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী পেয়েছে। সেই সময়ে আনিস এমন কোনো আন্দোলন ছিল না যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।” আর প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম মানুষদের মধ্যে ‘উজ্জ্বলতম মানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং সুলতানা কামাল অতি সংক্ষিপ্ত বয়ানে আনিসুজ্জানের মহাকাব্যিক জীবন তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “আনিসুজ্জামান কখনো তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। দায়বদ্ধতা ও সততায় অবিচল ছিলেন। সময়ের দায়ভার নিষ্ঠার সঙ্গে বহন করেছেন।”
দেশে এবং বিদেশে প্রচুর সম্মাননা তিনি পেয়েছেন, ভূষিত হয়েছেন বহু পুরস্কারে ও পদকে। কিন্তু এই মানুষটির জন্য প্রতিনিয়ত যে পুরস্কারটি অপেক্ষা করে তা হলো এ দেশের মানুষের ভালোবাসা। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি সুস্থ-সুন্দর ও কর্মঠ দেহ-মনে বেঁচেছিলেন ৮৩ বছর। আজ তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বাঙালি জীবনে চেতনার এই বাতিঘর বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। হে প্রিয়জন, আপনার বিদেহি আত্মার অনন্ত শান্তি কামনা করি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে