করোনার চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির জন্য আজ শনিবার (১৬ মে) থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে শুরু হচ্ছে প্লাজমা সংগ্রহ। ঢামেক হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আমহেদ খান বলেন, ‘আপতত এখানে ভর্তি থাকা রোগীদেরকেই এ থেরাপি দেওয়া হবে। পরে কুর্মিটোলা বা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল আগ্রহী হলে সেখানেও এ থেরাপি দেওয়া হবে।’ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জনিয়েছেন, রক্তের তরল হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলা হয়। রক্তের মধ্যে তিন ধরনের কণিকা ছাড়া বাকি অংশই রক্তরস আর রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস।
ঢামেক হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপির শুরু হবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডা. দিলদার হোসেন বাদল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. পিয়াসের প্লাজমা দেওয়ার মাধ্যমে। তারা দু’জনই করোনা জয়ী। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন ডা. তানভীর ইসলাম।
অধ্যাপক মহিউদ্দিন বলেন, ‘যারা করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাই প্লাজমা দেওয়ার বিষয়ে খুব একটা সাড়া পাচ্ছি না। এজন্য সুস্থ হওয়াদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন প্লাজমা দিতে এগিয়ে আসেন।’
চিকিৎসকরা জানান, প্লাজমা থেরাপিতে শতভাগ সাফল্য আসবে বা মৃত্যুরোধ করা না যাবে না। তবে যেহেতু কোভিড-১৯ এর কোনও চিকিৎসা এখনও নেই আর প্লাজমা থেরাপির কোনও ক্ষতি নেই তাই পরীক্ষামূলক এটা দিতে সমস্যা নেই।
প্লাজমা থেরাপি কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে চিকিৎসকরা বলছেন, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাস মোকাবিলা করে টিকে থাকতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ওই অ্যান্টিবডিই অসুস্থদের সারিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার হবে। এটা একেবারেই রক্তদানের প্রক্রিয়ার মতো একটি প্রক্রিয়া, কেবল এখানে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হতে হবে এটুকুই পার্থক্য। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১৪ দিন একজন ব্যক্তি প্লাজমা দিতে পারেন।
অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পরপরই যেসব রোগীদের শ্বাসকষ্ট শুরু হবে তাদেরকে যদি সঙ্গে সঙ্গে একব্যাগ বা ২০০ মিলিলিটার প্লাজমা দেওয়া যায় তাহলে তার অবস্থা খারাপের দিকে না গিয়ে ফল ভালো আসে। কারণ প্লাজমা শরীরের রক্তের মধ্যে যে ভাইরাস থাকে তাকে অকেজো করে দেয়। অ্যান্ডিবডি তৈরি করে ভাইরাসের বিপক্ষে।’
প্লাজমা থেরাপির জন্য দাতার শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য কিট প্রয়োজন হয়। সেটা গত সপ্তাহে আনার জন্য অর্ডার দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দাতার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ জানতে যে টেস্টের প্রয়োজন হয় তার প্রতিটি কিটের দাম দেড় লাখ টাকা। এ ধরনের চারটি কিট প্রথমে তারা আনছেন। আর একটি কিটে ৯৬টি পরীক্ষা করা যাবে।’
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) একে অনুমোদন দেওয়ার পর অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন এ উদ্যোগ নেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানানো হলে ১২ এপ্রিল এ নিয়ে বৈঠক হয়। ১৮ এপ্রিল তাকে প্রধান করে চার সদস্যের টেকনিক্যাল সাব কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বাকি তিন সদস্য হলেন ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির এবং ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সি।
১৯১৮ সালে স্প্যানিস ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ব্যবহার করা হয়েছিল প্লাজমা থেরাপি। এর থেকে সার্স, মার্স এবং ইবোলাতেও এর ব্যবহার হয় বলে জানান অধ্যাপক মহিউদ্দিন খান। চীনের উহানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা পাঁচ রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার পর তারা সুস্থ হয়েছেন। পরে তারা ভেন্টিলেশনে থাকা তিনসহ ১০ জন রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেয় এবং তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে বড় কোনও গবেষণা হয়নি বলে ইউএস এফডিএ একে ইমার্জেন্সি ইনভেস্টিগেশনাল নিউ ড্রাগ হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ গবেষণামূলকভাবে প্রয়োগ করে দেখা হবে এতে করে কতখানি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসে।
এদিকে, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক জানান, গত ২৭ এপ্রিল থেকে এ ইন্সটিটিউটে প্লাজমা থেরাপির জন্য প্লাজমা ব্যাংক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। প্লাজমা ব্যাংক হিসেবে প্লাজমা ‘স্টোর’ করে রাখা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল চাইলেই তারা ব্যাংক থেকে প্লাজমা দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। এ ইন্সটিটিউটে এখন পর্যন্ত দু’জন প্লাজমা দিয়েছেন এবং আগামী দুই একদিনের মধ্যেই আরও দুজন প্লাজমা দেবেন বলে জানান তিনি।
কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ধকলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন রোগীরা। তাই অনেকেই এ বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছেন না মন্তব্য করে ডা. আশরাফুল হক বলেন, যার কারণে ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন সুস্থ হওয়া মানুষ ৪০০-৬০০ মিলিলিটার পর্যন্ত প্লাজমা নেওয়া যায়। একজন রোগীর সাধারণত ২০০ মিলিলিটারের মতো প্লাজমা দরকার হয়। সে হিসেবে আমাদের কাছে থাকা দু’জনের প্লাজমা দিয়ে পাঁচজনকে এটা দেওয়া যাবে বলেন ডা. আশরাফুল হক।
তিনি বলেন, ‘যারা সুস্থ হচ্ছেন তারা যদি ২০-৩০ মিনিট সময় দিতে পারেন তাহলে তার রক্তে আরও তিনজন জীবন লাভ করতে পারেন। তাই যদি সবাই মিলে প্লাজমা ব্যাংককে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো বা অনেকের চলে যাওয়া (মারা যাওয়া) কমাতে পারবো’।
তিনি জানান, ভারতে ৩৮টি প্রতিষ্ঠানে প্লাজমার কাজ চলছে। আরও ৮৩টি ইন্সটিউটে হয়তো আগামী সপ্তাহে এর অনুমোদন পাবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে গত ১১ মে পর্যন্ত আট হাজার ৭০০জনকে প্লাজমা প্রয়োগ করেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কোভিড-১৯ বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান হাবিবুর রহমান জানান, প্লাজমা থেরাপির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।