বাংলাদেশ মেডিক্যালে পরিক্ষামূলক প্রয়োগ: করোনার চিকিৎসায় কাজ করে আইভারমেকটিন!

বিশেষ প্রতিবেদক

করোনার ভয়াল রূপ
করোনার ভয়াল রূপ। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগীদের চিকিৎসায় অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল ওষুধ আইভারমেকটিন প্রয়োগ করেছেন বাংলাদেশের একদল চিকিৎসক , যা মূলত চর্মরোগসহ পরজীবীঘটিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই চিকিৎসকরা বলছেন, আইভারমেকটিন ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধিতে বাধা দেয়। আইভারমেকটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগ করে তারা দেখেছেন, কোভিড-১৯ রোগীদের উপসর্গগুলো তিন দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

universel cardiac hospital

আইভারমেকটিনের পরীক্ষামূলক এই প্রয়োগের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. তারেক আলম, যিনি ইন্টারনাল মেডিসিন ও শ্বাসতন্ত্রের রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, ওই ওষুধ তারা প্রথম প্রয়োগ করেন বাংলাদেশ মেডিকেলের কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের ওপর, যারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন কাশ্মিরি।এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ওই শিক্ষার্থীদের ওপর এটা প্রয়োগ করা হল। আমরা তাদের পাঁচজনকে সিঙ্গেল ডোজ দিলাম। দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে তারা সবাই ভালো হয়ে গেল। আমরা পরীক্ষা করে ফল নেগেটিভ পেলাম। তাদের রি-টেস্ট করার পরও করোনাভাইরাস নেগেটিভ এসেছে।

আইভারমেকটিন পরজীবীর সংক্রমণ সারাতে বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ ওষুধ হিসেবে বিবেচিত। তুলনামূলকভাবে কম দামি এই ওষুধ বাংলাদেশে সহজলভ্য।

নতুন করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে বিজ্ঞানীরা যখন এর প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তখন বিভিন্ন দেশে অন্য রোগের কিছু ওষুধও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, সেগুলো কোভিড-১৯ রোগীকে উপশম দিতে পারে কি না। এর মধ্যে আইভারমেকটিনও রয়েছে।

আইভারমেকটিন মূলত পরজীবীর নার্ভ ও অন্যান্য কোষে আক্রমণ করে একে পরাস্ত করে। তবে এ ওষুধ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কী করে কাজ করে, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে জানান ডা. তারেক আলম।

এই অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল ওষুধটি তৈরি করা হয়েছিল জাপানের কিতাসাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সাতোশি ওমুরার এক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, যে কাজের জন্য তিনি ২০১৫ সালে চিকিৎসায় নোবেল পান।

টোকিওর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ও সম্প্রতি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে আইভারমেকটিন ব্যবহার করে দেখার ঘোষণা দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি ও মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজও এ বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আইভারমেকটিন ব্যবহারে নতুন করোনাভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যায়।

আর ইউনিভার্সিটি অব উটাহর গবেষকরা বলছেন, আইভারমেকটিন প্রয়োগে কোভিড-১৯ রোগীদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।

আইভারমেকটিন আর ডক্সিসাইক্লিনের এই ককটেল এর আগে সার্স মহামারির সময়ও ব্যবহার করা হয়েছিল জানিয়ে ডা. তারেক আলম বলেন, এই ওষুধ ভাইরাসকে মারে। কীভাবে মারে সেটা আমরা এখনও বের করতে পারিনি।

তিনি জানান, বাংলাদেশ মেডিকেলের যে ইন্টার্ন চিকিৎসকের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেই কাশ্মিরি শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের নিতে সাত দিনের মধ্যে প্লেন আসার কথা ছিল। তাদের ক্ষেত্রে ফল পাওয়া গিয়েছিল তিন দিনের মধ্যে।

অধ্যাপক তারেক আলম আরও জানান, এ পর্যন্ত দেশের কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল কর্মী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনসহ সব মিলিয়ে ৬০ জনের ওপর ওই ওষুধের পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫০ জনের তথ্য হাসপাতালে আছে।

তিনি বলন, ওই ৫০ জনের সবারই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপসর্গ কমে গেছে। ২৫ জনের পরীক্ষা করে নেগেটিভ পাওয়া গেছে। বাকীদের এখনও পরীক্ষা হয়নি। ৮০ ভাগ কোভিড-১৯ রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই আশিভাগের সবাই বাসায় না থেকে ঘোরাফেরা করছেন। তাদের ওই ওষুধটা দিতে পারলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের সংক্রমণ সেরে ওঠার কথা। তাহলে তারা আর অন্যের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারবেন না।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুস সবুর বলেন, আমরা এই পরীক্ষাটি নিয়ে আশাবাদী। অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে এটা কাজ করছে দেখে। মেকানিজমটা এখনও জানা যায়নি, কিন্তু এটা করছে। এখন পর্যন্ত যেহেতু কোভিড-১৯ এর কোনো চিকিৎসা বের হয়নি, তখন এটা ভালো কাজ করলে আমরা কেন গ্রহণ করব না? এটা তো সিম্পল। এর কোনো টক্সিসিটি নেই, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাহলে আমরা দেখব না কেন?

সরকারি যেসব হাসপাতালে অনেক কোভিড-১৯ রোগী আছে, সেখানে এ ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সবুর। তিনি বলেন, আমাদের বিষয়টা আমরা জানিয়ে রাখলাম। এখন তা প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় দেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন মেনে চলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক সবুর বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল কোভিড-১৯ হাসপাতাল নয়। এখানে বাইরের কোনো রোগীকে ভর্তি করা হয়নি। আমাদের এখানে রোগী স্বাস্থ্যকর্মীরাই। কেউ হয়ত এসেছে রোগীর আত্মীয় হিসেবে। আমরা মানবতার খাতিরে মানুষের সুবিধার জন্য এই পরীক্ষামূলক চিকিৎসা দিয়েছি। ওই প্রটোকলটা সরকারি হাসপাতালের জন্য যেখানে কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া উইংয়ের সমন্বয়ক হাবিবুর রহমান খান বলেন, আমরা বিষয়টি শুনেছেন। সব প্রক্রিয়া মেনে এটি কাজে লাগানো যায় কি না সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে তারা সহায়তা করব। আরও বেশি মানুষের ওপর পরীক্ষাটা চালাতে হবে। ঔষধ প্রশাসন থেকেও একটা অনুমতির ব্যাপার আছে। ভালো ফল দিলে নিঃসন্দেহে এটাকে প্রমোট করা উচিত। আমরা যে কোনো ভালো পদক্ষেপেই সরকারের পক্ষ থেকে সমর্থন করতে চাই।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে