অনেক বেসরকারি মেডিকেলে বকেয়া পড়েছে চিকিৎসকদের বেতন

বিশেষ প্রতিবেদক

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ

মহামারি করোনাভাইরাস সঙ্কটে দেশের অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন বকেয়া পড়েছে, ঈদের বোনাসও পাননি তারা।

এই সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর ৬১ শতাংশ চিকিৎসকের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকদের একটি সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন-বিডিএফের এক জরিপ।

universel cardiac hospital

তবে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন ওই জরিপের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছে, তাদের কাছে এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।

এদিকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। সেখানে ১২০ জনের মতো শিক্ষক রয়েছেন।

সেখানকার এক শিক্ষক বলেন, আমাদের এপ্রিলের বেতন এখনো হয়নি। তিন দিন আগে মার্চ মাসের বকেয়া অর্ধেক বেতন পেয়েছি। আমরা সবাই একটি আবেদন করেছিলাম। তারা বলেছে, তারা বেতন দিতে অপারগ। এপ্রিল মাসের বেতন নাকি প্রয়োরিটি ভিত্তিতে দেওয়া হবে। কাউকেই বোনাস দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবদুল হাই চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাস সঙ্কটের কারণে এমন হয়েছে। বকেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। করার তো কিছু নাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেতন ভাতা পরিশোধ করা হবে।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, গত ডিসেম্বরে সবশেষ বেতন পেয়েছি। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন এখনও হয়নি। আমরা অনেক দেনদরবার করেছি। তারা দিব, দিচ্ছি করছে। বলছে তাদের ফান্ড নাই। হাসপাতালে পেশেন্ট নেই। আমরা যদি বেতনটা না পাই তাহলে কীভাবে চলে?

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে হলিফ্যামিলি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মোর্শেদ বলেন, বেতন নিয়ে সমস্যা আগে থেকেই ছিল। সমস্যাটি সমাধানের ‘চেষ্টা’ করছি। তিন মাসের বেতন বকেয়া ছিল। ইতোমধ্যে আমরা এক মাসের বেতন দিয়েছি। বাকিগুলোও আস্তে আস্তে দিয়ে দেব।

রাজধানীর কেয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনের ৩ ভাগের দুই ভাগ বেতন পেয়েছি। মার্চ-এপ্রিলের বেতন হয়নি। নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয় সবারই এক অবস্থা।

টাঙ্গাইলের কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের মার্চ মাসের বেতন পাননি অনেক চিকিৎসক।

সেখানকার একজন চিকিৎসক বলেছেন, লকডাউনের আগে নিয়মিত বেতন হলেও এখন সমস্যায় পড়েছি আমরা। কর্তৃপক্ষ বলেছে, শুধু যারা উপস্থিত থাকবে তাদের বেতন দেওয়া হবে। তারা অনুপস্থিতির অজুহাতে বেতন দিবে না। এটি ট্রাস্টের মাধ্যমে চলে। এখানে একটা বছরের বাজেট থাকে। স্যালারি কেন হবে না?

এ বিষয়ে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবদুল হালিমকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তিনি ‘সঠিক ব্যক্তি’ নন।

ডক্টরস ফাউন্ডেশন গত ১৩ থেকে ১৫ মে অনলাইনে জরিপ চালিয়ে পরিস্থিতির ব্যাপকতা বোঝার চেষ্টা করে।

৫১৯ জন চিকিৎসকের ওপর চালানো ওই জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সঙ্কট শুরুর পর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর ৬১ শতাংশ চিকিৎসকের বেতন অনিয়মিত; বোনাস পাননি ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মীদের গত বছরের বেতনও বকেয়া রয়েছে। তাদের অভিযোগ, এখন মহামারির কথা বলে তাদের বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে না।

ঢাকার সিটি মেডিকেল কলেজের মেডিকেল শাখার এক চিকিৎসক জানান, ২০১৯ সালের মে মাসের বেতন এখনও তারা পাননি । বেতন পেতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করেও কোনো কাজ হয়নি।

ঢাকার পাশে রূপগঞ্জে ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজের এক সহযোগী অধ্যাপক বলেন, আমাদের পাঁচ মাসের বেতনের গ্যাপ তৈরি হয়েছে। আমরা ডিসেম্বরের বেতন পেয়েছি ২৩ এপ্রিল।

বিডিএফের সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাস বলেন, কোভিড-১৯ এর অজুহাতে অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসক ও কর্মীদের বেতন দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই জরিপ চালিয়েছি আমরা।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৫০ হাজারের বেশি চিকিৎসক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালগুলোতে চাকরি করে। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই, অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও কম। এই দুর্যোগের সময় তাদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া তো অমানবিক। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো যখন ব্যবসা করেছে তখন তো লাভের অংশ চিকিৎসকদের দেয়নি। এখন কোভিড-১৯ এর অজুহাতে বেতন কেন দেবে না?

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি মুবিন খান বলেন, কেউ কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে করেনি। এই জরিপ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করা হচ্ছে।

তবে অনেক জায়গায় বেতন যে বকেয়া আছে, সেটা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কথায় স্পষ্ট।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইনগতভাবে সরকারের ‘হস্তক্ষেপ করা কঠিন’। আমি বলব, তাদের বেতনটা পরিশোধ করে দেন। তারা কাজ করেছে, বেতন কেন বাকি থাকবে?

করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে আর্থিক সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে এবার রোজার ঈদে শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের উৎসব ভাতা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মালিকরা।

গত ২ মে বিপিএমসিএর নির্বাহী কমিটির সভায় ঠিক হয়, এপ্রিল মাসে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের ৬০ শতাংশ বেতন দেওয়া হবে। তবে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা শতভাগ বেতন পাবেন।

এছাড়া যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন, তাদেরকে শতভাগ বেতন দেওয়া হবে। কলেজ স্টাফদের মধ্যে যারা অনুপস্থিত, তারা পাবেন ৬০ শতাংশ বেতন।

ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে গত ৪ মে শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বেতন কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিপিএমসিএ। তবে ঈদ বোনাস না দেওয়ার সিদ্ধান্ত অটল থাকেন মালিকরা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে