করোনা ভাইরাসের মহামারির একপিঠে যেমন জীবন-জীবিকার ঝুঁকি, ঠিক তেমনি এর উল্টো পিঠেই উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনা। করোনা-পরবর্তী বদলে যাওয়া বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আসতে পারে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ। এমনটাই মনে করছে সরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তার ওপর একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকার। অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্মিলিতভাবে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
ওই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনার যে আচমকা আঘাত সেটার রেশ টানতে হবে অনেক বছর। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে থাকবে। তবে করোনার উৎপত্তিস্থল চীন থেকে জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে।
অর্থাৎ বাণিজ্য সাম্রাজ্যে চীনের আধিপত্য শেষ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীন থেকে সরে আসা এসব রাষ্ট্রকে বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে অনতিবিলম্বের জিটুজি (সরকার টু সরকার) পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন মত ও পথকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। যেসব কোম্পানি চীন থেকে রিলোকেট করার চিন্তা করছে, তাদের সাথে আমাদের ব্যবসায়ীদের আলাপ করার জন্য জানিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের তালিকা সংগ্রহ করে তাদের জানিয়েছি যে, আপনারা যেসব কোম্পানি চীন থেকে চলে যেতে চায় তাদের সাথে আলাপ করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছেও এসব তথ্য দিয়েছি। আমরা চাই বিশেষভাবে বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হোক। তাদের বলা হোক, বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমাদের ১০০টা ইকোনমিক জোন হচ্ছে, ২৮টা হাইটেক পার্ক হচ্ছে। এসব জায়গায় আমেরিকা, জাপানসহ অন্যান্য দেশ বিনিয়োগ করতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান একটি করে ইকোনমিক জোন নিয়ে নির্দ্ধিধায় বিনিয়োগ করে তাদের ফ্যাক্টরিগুলো চালু করতে পারে। আমরা এসব দেশকে বলেছি যে, বাংলাদেশ হচ্ছে বাণিজ্যবান্ধব দেশ। বর্তমানে সরকার স্থিতিশীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে এর লভ্যাংশ সহজেই নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুব ভালো, এসব তথ্যই তাদের জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, জাপানের যেসব প্রতিষ্ঠান চীনে পণ্য উৎপাদন করছে তাদের জাপানে ফিরিয়ে নিতে দুই বিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজও ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। এছাড়া দেশটি চীন থেকে সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় জাপানি কলকারখানা সরিয়ে নেয়ার জন্য ২৫ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চায়না ট্রেড যুদ্ধের কারণে হয়তো অনেক ইউএস কোম্পানিও চলে যাবে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি একটা নিউজ এসেছে যে, ২৭টি ইউএস কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ায় চলে যাচ্ছে। এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি, বেশকিছু আমেরিকান ও জাপানি কোম্পানি ভারতে যেতে চেষ্টা করছে। রাজনৈতিকভাবেও ভারত সরকার তাদের নেয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, তবে এসব বিনিয়োগ পেতে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। গ্লোবাল ইকোনোমিতে একচেটিয়াভাবে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও অন্যান্য দেশের ন্যায় সুযোগ-সুবিধাও সৃষ্টি করতে হবে। সুবিধা দিতে আমরাও কিছু কাজ করছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও কিছু কাজ হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের সভাপতিত্বে বিডা, বেপজা, পিপিপি অফিসসহ আমরা পৃথক পৃথক বৈঠক করেছি। বিদেশিরা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে বেশকিছু সমস্যায় পড়েন, এসব সভায় আমরা বিষয়গুলো তুলে ধরেছি।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশসমূহ যেসব সুবিধা দিচ্ছে এগুলো তুলে ধরেছি, যেমন- ট্যাক্স হলিডে বাড়ানোর দরকার আছে। এছাড়া জমির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে, যেটা আগে ছিল না। এটা মওকুফের সুপারিশ করা হয়েছে। আমেরিকার ২৭টি কোম্পানিকে বিনিয়োগের জন্য ইন্দোনেশিয়া চার হাজার হেক্টর ফ্রি জমি দিচ্ছে। আর আমরা জমির দাম নেয়ার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাটও নিচ্ছি। তাই ভ্যাট মওকুফের সুপারিশ করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে যে, পলিসি স্থিতিশীল নয়। তাই আমরা বলেছি, এক্ষেত্রে যে পলিসিটা করা হবে সেটা পাঁচ বা সাত বছরের মধ্যে যেন পরিবর্তন না হয়, এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে করা। আরও বেশকিছু সুপারিশ আমরা দিয়েছি।
এগুলো সিদ্ধান্ত আকারে আসলে সেগুলো নিয়ে আমরা এসব বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানাব- বলেন বিডা চেয়ারম্যান।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, চায়না থেকে রিলোকেশন ছাড়াও আরও বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বিডা কাজ করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ১৮ বিলিয়ন ডালরের বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে, সেগুলোও যেন কোনো কারণে চলে না যায় সে বিষয়েও আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনতে মাধ্যম হিসেবে তাদের চেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জাপানের এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আমি নিজে বৈঠক করেছি। আগামীতে আমরা আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সাথে বৈঠক করব। এছাড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন বিজনেস সংগঠনের সাথে একাধিক বৈঠক করে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা জেনে সেগুলো সরকারের নিকট পাঠিয়েছি।
এখন বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান দরকার— জানিয়ে বিডার চেয়ারম্যান বলেন, বিদেশিরা যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসে, সে কাজটা করছি। এজন্য এক্সপার্ট সাপোর্টও নেয়া যেতে পারে অর্থাৎ যারা এসব কাজ করেন এমন একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দেয়ার চিন্তা করছি আমরা।
বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, জাপান চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিলে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি এর গন্তব্য হতে পারে বাংলাদেশও। বাংলাদেশে বিনিয়োগে জাপান বেশ আগ্রহী। এজন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের জন্য উপযোগী প্যাকেজসহ যা যা করণীয় করতে হবে আমাদের।