সামনে ঈদ উৎসব। করোনা আক্রান্ত এই সময়ে উৎসব কতটা আনন্দের হবে আমরা তা জানি না। তার পরও ঘরে ঘরে মুসলমানদের ঈদের আয়োজন নবীন-প্রবীণ সবাইকে উৎসাহিত করবে। কারণ এক বছরে ঈদুল ফিতর আমাদের আনন্দের উৎসব হয়ে আসে।
ধর্ম একটি জনগোষ্ঠীর জীবন আচরণের অনেক উপাদানের একটি। সুতরাং ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে জীবনের স্বাভাবিক অন্বেষাকে বিনষ্ট করা হয়। এবং ধর্মের শাশ্বত শুভ বোধকে খাটো করা হয়। ইসলামে আছে, ‘লাকুম দ্বিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিন’ অর্থাৎ আমার ধর্ম আমার, তোমার ধর্ম তোমার। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত সত্য উপেক্ষা করে মানুষ যখন ধর্মান্ধ হয় তখনই সমূহ বিপদ ঘটে। নিজের ধর্মকে একতরফাভাবে বড় করে দেখতে গিয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যের ওপর। ধর্মের নামে এ দেশে রক্তপাত ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ধর্মের উসুল আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। ধর্মান্ধতা সামাজিক ব্যাধি। যে ধর্মান্ধ তাকে ধর্ম অন্ধ করে। সে যুক্তিহীন হয়ে পড়ে। সে অমানবিক। তার হৃদয়ে প্রেম থাকে না। তার মস্তিষ্ক ঈশ্বরশূন্য। সে ঈশ্বরের দোহাই দেয়, কিন্তু প্রকৃত ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে না। যে ধার্মিক সে ধর্মের প্রকৃত অর্থ বোঝে। ধর্ম তাকে যুক্তিহীন করে না। সে মানবিক। মানবতা তার কাছে ধর্মতুল্য। ধর্মের মৌল বিষয় তাকে আলোকিত করে। সে প্রেমিক। ঈশ্বর তার হৃদয়ে থাকে। মানুষ তার কাছে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
ধর্মান্ধতার জিগিরে এই দেশে বেশ কয়েকবার দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতায়, একই বছরে ভয়াবহ দাঙ্গা বেধেছিল নোয়াখালীতে। মহাত্মা গান্ধী শান্তির বাণী নিয়ে নোয়াখালীতে এসেছিলেন। ১৯৫০ সালে দাঙ্গা হয়েছিল ঢাকায়। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা বাধলে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ বলে তিনি প্রচারপত্র ছেড়েছিলেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে দাঙ্গাকারীদের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমুসলিমদের ওপর নির্যাতন করেছিল বেশি, সেটাও ছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে উদ্বুদ্ধ হওয়া। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে আবার দাঙ্গা বেধেছিল। কিন্তু সে সময়ের ঘটনাগুলো গণমানুষের প্রতিরোধের মুখে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।
আমি মনে করি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শব্দ দুটি এক অর্থে মানবিকতার লজ্জা ও গ্লানি। মানব সভ্যতার এমন কোনো শব্দের সৃষ্টি মানবিক বোধের ব্যর্থতার ফল। এই ব্যর্থতা বিভিন্ন সময়ে মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতায় কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। সময়ের সাদা হাত সে কলঙ্ককে মুছে ফেলতে পারে না।
যেখানে সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও স্বার্থ সম্পর্কিত বিভেদের সৃষ্টি হয়, সেখানেই নষ্ট হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এই সম্প্রীতি ভাঙা যেমন সহজ, তেমনি রক্ষা করাও কঠিন। মানুষের ঘৃণ্য স্বার্থবুদ্ধি বিভিন্ন সংযোগে এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে মানুষের হাতে শুরু হয় মানুষের নিধন। এখানেই আমার আপত্তি। আমার অধিকার নিয়ে আমি বসবাস করব। কারো হাতের ক্রীড়নক হতে চাই না। সেটা ধর্মের নামে হোক বা অন্য কোনো অজুহাতে হোক। তার পরও মানুষের বিকৃত উল্লাস কলঙ্কিত করছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা।
‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিই অপমানজনক। মানুষ হিসেবেই তো সবার স্বীকৃতি। এই অধিকার নিয়েই তো সে সমাজের মানুষ। তাহলে তাকে কেন একটি শব্দ দিয়ে বস্তাবন্দি করা? এটা মানবিক অধিকার লঙ্ঘন। কোনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের এই শব্দ ব্যবহারের অধিকার থাকা উচিত নয়। এটি ন্যায়সংগতও নয়। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি ‘সুবিচার নিশ্চিত’ করা হবে। এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এটিও অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ বলে আমরা বিশ্বাস করি। মাকে ‘মা’ বলেই ডাকতে হয়। নইলে মায়েরই অপমান। তেমনি ডাকার একটি ব্যাপার আছে। ডাক যথার্থ না হলে তার অবমাননা হয়, এটি সামাজিক সত্য। মূল্যবোধের সত্য। সে জন্য ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহৃত না হলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ হবে মানুষ।
সম্প্রদায়ের পরিচয়ের ভিত্তি কেন মানুষ হিসেবে হবে না—কেন ধর্ম কিংবা অন্য কোনো বিষয় মানুষের পরিচয় মুছে দিয়ে বড় হয়ে উঠবে? কেন স্বার্থসিদ্ধির দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এক দল তাড়া খেয়ে ছুটবে খানিকটুকু আশ্রয়ের জন্য? ভূপেন হাজারিকার একটি গানের লাইন এমন :
‘সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের
ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ
যখন গুমরে কাঁদে
আমি যেন তার নিরাপত্তা হই।’
এই গান শুনলে অদ্ভুত এক কালো পর্দা নেমে আসে মনের ওপর। ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ নিজেদের বুকের ভেতরে গুমরে মরে।
আমরা সব ধর্মের উৎসব নিজেদের উৎসব মনে করে ঐক্যের পতাকাতলে দাঁড়াতে চাই। আমরা যিশুখ্রিস্টের বন্দনায় শরিক হতে চাই। আমরা গৌতম বুদ্ধের বন্দনায় শরিক হতে চাই।
রাজনীতির কারণে মানুষকে আমরা সংখ্যালঘু বানাতে চাই না, রাজনীতির কারণে মানুষের নিধনযজ্ঞ আমরা দেখতে চাই না।
মানবিকতা হোক আমাদের একমাত্র আশ্রয়। মানুষের কল্যাণই হোক আমাদের ধর্ম।
সব স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে আমরা এই ধর্মের জয়গান গাইব।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস যেভাবে মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছে উৎসবের আনন্দ বিশ্বজুড়ে মানুষকে এক পাটাতনে নিয়ে আসুক এটাই বর্তমান সময়ের আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক