বিশ্বমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই) উৎপাদনকারী দেশের কাতারে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের টেক্সটাইল খাতের নেতৃত্বস্থানীয় ব্র্যান্ড বেক্সিমকো সোমবার (২৫ মে) মার্কিন ব্র্যান্ড হেইনস-এর কাছে ৬৫ লাখ পিপিই গাউনের একটি চালান পাঠিয়েছে। চালানটি পৌঁছবে মার্কিন কেন্দ্রীয় জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (ফেমা) কাছে।
সোমবার চালান হস্তান্তরের মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর. মিলার। তারা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে বেক্সিমকোর তৈরি পিপিই’র ওই চালানটির বিদায় জানান।
কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী এক নজিরবিহীন মহামারিতে রূপ নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষকে নিরাপদ রাখতে পিপিই’র প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই বেক্সিমকো দ্রুতই তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে ব্যবহার করে গাউন, মাস্ক ও কভার তৈরির মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক এ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়।
বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গ্রুপ পরিচালক সৈয়দ নাভেদ হোসেনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চালান হস্তান্তর অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে বিশ্বের কার্যপদ্ধতি পাল্টে গেছে। তাই বেক্সিমকোকেও জরুরিভিত্তিতে সক্রিয় হতে হয়েছে।
তিনি বলেন, মাত্র দুই মাসের মধ্যে আমরা আমাদের বিশ্বমানের উৎপাদন, প্রযুক্তিগত ও ডিজাইন দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রয়োগ করে পিপিই তৈরি করতে শুরু করি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী অতিপ্রয়োজনীয় পিপিই-এর সরবরাহ বৃদ্ধিতে অবদান রাখে বেক্সিমকো।
তিনি আরও বলেন, পিপিই উৎপাদনের নতুন কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়ার জন্য জুতসই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এতে একদিকে যেমন বিশ্বব্যাপী মানুষ নিরাপদে থাকবে, অপরদিকে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনীতিও সচল থাকবে। দেশের গার্মেন্ট খাতের ৪১ লাখ শ্রমিকের বিশাল কর্মীবাহিনীও ভালোভাবে জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে পারবে।
বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের প্রধান নির্বাহী বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকে এ প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে চান, জীবন বাঁচাতে চান। বেক্সিমকো এক্ষেত্রে পথ দেখিয়ে চলছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেক্সিমকোর অবদানের প্রশংসা করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো বাকি বিশ্বও মহামারির সাথে লড়াইয়ে এক কঠিন সময় পার করছে। এমন এক সংকটময় সময়ে বাংলাদেশ মাত্র দুই মাসের মধ্যে এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য খাতের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ বাজারে রফতানি করছে; তাও আবার ১০/২০ হাজার নয় ৬৫ লাখ পিস। এ এক অভাবনীয় অর্জন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর. মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম বড় ধরনের পিপিই চালান যাচ্ছে। বিশ্ববাজারের জন্য বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যায় বৈশ্বিক মানের পিপিই উৎপাদনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র। বেক্সিমকো ও হেইনস’র চুক্তিতে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ দুটি মহান দেশ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কীভাবে লড়াই করছে।
তিনি বলেন, এসব কিছুই হয়েছে মাত্র দুই মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধের পর থেকে পরের দুই মাসের কথা একবার ভাবুন। বেক্সিমকো ও বাংলাদেশ যারপরনাই দ্রুত সময়ে পিপিইর উৎপাদন শুরু করে। ফলে আজকের এই এয়ারক্রাফটটি অতি প্রয়োজনীয় পিপিই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক উভয় দিক থেকে দুর্দান্ত গতিতে এ কাজ হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেক্সিমকোকে অর্থায়নের সুযোগ পেয়ে জনতা ব্যাংক গর্বিত। আমরা অন্যান্য রফতানিকারকদেরও অর্থায়ন করব যেন অর্থনীতির চাকা সচল থাকে; না হলে সব কিছু ভেঙে পড়বে।
বেক্সিমকো ফার্মার ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাজমুল হাসান এমপি এ অনুষ্ঠানকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, আজ আমরা বিপুল পরিমাণে বিশ্বমানের পিপিই উৎপাদনকারী দেশের কাতারে যোগ দিলাম।
তিনি বলেন, মহামারির প্রথমদিকে দেশে পিপিইর প্রচুর চাহিদা ছিল এবং বেক্সিমকো পিপিই আমদানি করে দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রয়োজন মেটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চাহিদা বাড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে পিপিইর স্বল্পতা দেখা দেয়। এরপর আমরা বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে পিপিই উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেই। এখন আমরা শুধু দেশের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ-ই নয়; বরং বিশ্বে পণ্যমানের দিকে কড়া নজরদারির দেশগুলোতেও তা রফতানি করছি।
বিশ্বমানের উৎপাদন ও গবেষণা স্থাপনাসমৃদ্ধ, বাংলাদেশের একমাত্র এফডিএ-সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মা সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম কোম্পানি হিসেবে রেমডেসিভিরের জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ এই রেমডেসিভিরকে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই ওষুধ কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর।
বেক্সিমকো টেক্সটাইল ডিভিশন দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে দ্রুত উৎপাদনক্ষম, সৃজনশীল ও টেকসই টেক্সটাইল ও ফ্যাশন পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৪০ হাজার মানুষ। টার্গেট ইউএসএ, জারা, মাইকেল কর্স, পিভিএইচ, টমি হিলফিগার, কেলভিন ক্লেইন, অ্যামাজন, সিঅ্যান্ডএ- এর মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পোশাক ও ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর কাছে প্রতিদিন চার লাখ তৈরি পোশাকের চালান সরবরাহ করে বেক্সিমকো টেক্সটাইলস। বেক্সিমকোর ফ্যাশন রিটেইল চেইন ‘ইয়েলো’ বর্তমানে বাংলাদেশের এক নম্বর ফ্যাশন ব্র্যান্ড।
বেক্সিমকো তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ও টেক্সটাইল ডিভিশনের জ্ঞান, দক্ষতা ও রিসোর্স একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করেছে বেক্সিমকো পিপিই ডিভিশন। ৩৫০ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে নতুন পিপিই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।
বেক্সিমকোর সকল প্রতিষ্ঠানের মতোই নতুন পিপিই ডিভিশনও একটি দীর্ঘমেয়াদের উদ্যোগ। গাউন, কাভারঅলস, মাস্কসহ সকল ধরনের পিপিই পণ্যের জন্য বিশ্বমানের পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছি প্রতিষ্ঠানটি। বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পিপিই নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চায় বেক্সিমকো পিপিই ডিভিশন।
ওই লক্ষ্যে শিকাগোভিত্তিক জেস্ট ডিজাইনস-এর সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি করেছে বেক্সিমকো। যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে স্থানীয় সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় যৌথভাবে একটি পিপিই উৎপাদন কারখানা স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে উভয় প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে ডেট্রয়েট শহরে কোভিড-১৯ পিপিই সরবরাহ করছে জেস্ট।