আপাতত আমরা করোনাযুগে অবস্থান করছি। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও সত্য। শুধু আমরা বাংলাদেশিরাই নই, গোটা বিশ্ব একই পরিবেশে বসবাস করছে, কম আর বেশি তীব্রতায়। গতকালই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘করোনা এখন এখানে সর্বোচ্চ মাত্রায়—আমরা আগুনের মধ্যে সময় কাটাচ্ছি।’
কথাটা তিনি হয়তো ভুল বলেননি তাঁদের পেশাগত বিপত্তির বিবেচনায়। শুনতে পাই স্বাস্থ্যবিধি-ব্যবস্থা সংক্রান্ত অপ্রতুলতার কথা এবং তা নানামাত্রিক। ব্যবস্থাপনার শিথিলতা ও সমন্বয়হীনতার মতো অভিযোগ অনেক দিন থেকে গণমাধ্যমে, বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হতে দেখছি। যেখানে ভয়ংকর সামুদ্রিক ঘূর্ণিবাত্যার আক্রমণের ভয়াবহতা আমরা একাধিকবার সামাল দিয়েছি, সেখানে ধীরেসুস্থে আগত করোনাভাইরাসের আক্রমণ সামাল দেওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সমালোচনার সম্মুখীন কেন?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাওয়ার আগে করোনাবিষয়ক বহু-আলোচিত কিছু কথার উল্লেখ সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক নয়। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে একটি কথাই বারবার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিহাসচ্ছলে জীবনানন্দীয় ভাষার ঢংয়ে বলতে পারে—এবার দেখে নেওয়া যাক তোমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার মাত্রা আর মানবিক চেতনাই বা কত দূর।
এমন একটি প্রশ্নের জবাব ইতিবাচকতার পাশাপাশি নেতিবাচকতাও কম নয়—যেমন ত্রাণ বিতরণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একাংশে দুর্নীতিপরায়ণতায়, তেমনি বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাসেবা দানের ক্ষেত্রে অমানবিক চরিত্রের প্রকাশে, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ীকুলের মুনাফাবাজিতে, সর্বোপরি জাতীয় স্বার্থের প্রতি ব্যাপক মাত্রায় উদাসীনতায় এবং নিয়ম না মানার নৈরাজ্যিক আচরণে।
দুই.
এবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরি। ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা নিয়মিতই দেখি, শুরুতেই ধাপে ধাপে আবহাওয়া দপ্তর থেকে সতর্কতা সংকেত জারি তার মাত্রা নির্দেশ করে, এরপর একই ধারায় বিপত্সংকেত ঘোষণা, যতক্ষণ না পর্যন্ত দুর্যোগ আমাদের জীবনে আছড়ে পড়ে। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিই, যতটা সম্ভব জানমালের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিরোধে। কিন্তু করোনা আক্রমণের বিশ্বব্যাপী বিপত্সংকেত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যথারীতি নিয়মিত ঘোষণা এবং তার যথাসম্ভব প্রতিরোধে করণীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক বিধি-বিধান নির্দেশনা সত্ত্বেও আমরা যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন হয়নি। হাতে যথেষ্ট সময় ছিল।
করোনার আবির্ভাব যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশালায়তন দেশ চীনের একটি প্রদেশে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে এর বিস্তার মারিতাত্ত্বিক বিচারে স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি তেমনই। সেই হিসাবে বাংলাদেশ আক্রমণের বাইরে থাকার কথা নয়।
যে কারণেই হোক, করোনাভাইরাস তার মতলব বদলে তার গতিপথ পাল্টে ইউরোপকে টার্গেট করে নেয়। তাই বলে তার আবার মত বদলাতে কতক্ষণ, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক পরিবেশ তছনছ করে দিয়ে?
বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সতর্ক সংকেতের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিরোধ ও সম্ভাব্য চিকিৎসাব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়ে ছক কাটা দরকার ছিল আমাদের সীমিত ক্ষমতার কারণে এবং তা করোনার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী লড়াইয়ে। যেমন প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে, তেমনি সম্ভাব্য চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞগণ এ কাজ কতটা দক্ষতার সঙ্গে করেছেন তা আমার জানা নেই। কিন্তু করোনা আক্রমণের শুরুতেই দেখা গেল আমাদের বেহাল দশা। চিকিৎসক-সেবিকাদের করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে মনে হলো যেন এক অপরিকল্পিত অসহায় অবস্থানে।
করোনাভীতি ও আতঙ্ক এবং মৃত্যুভীতি তাদের এমন মানসিকতায় পৌঁছে দেয় যে সাধারণ রোগীরাও এক অসহায় অবস্থার সম্মুখীন চিকিৎসাসেবা নিয়ে। ফলে কিছুসংখ্যক অবাঞ্ছিত করুণ মৃত্যু, যার কোনো সান্ত্বনা নেই।
আরো দেখা গেল, করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের অবস্থা অপর্যাপ্ত, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা বিচারে। তেমনি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। বিশেষভাবে দেখা গেল করোনা ও অন্যান্য চিকিৎসাক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সহযোগিতার অভাব।
এ বিষয় নিয়ে মনে হয় প্রাথমিক পর্বে বড়সড় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক সমঝোতায় পৌঁছানো দরকার ছিল। তা ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। কাজেই জাতীয় স্বার্থেও সম্ভাব্য সংকট নিরসনে তাদের ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ ছিল না।
তিন.
করোনাভাইরাস যখন ঠিকই তার আক্রমণ শুরু করল, তখন প্রতিরোধব্যবস্থার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশে ‘লকডাউন’ (মানুষের ঘরবন্দি হয়ে থাকা) ঘোষণা ছিল যুক্তিসংগত ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত সিদ্ধান্ত। সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিধি-নিষেধাদি।
ঢাকাবাসী মানুষের জন্য এটা অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা হলেও এর কোনো বিকল্প ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রীতি-নীতি ও বিধি-বিধানমাফিকই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যদিও সবাই যে এসব বিধি-বিধান মেনে চলেছে, তা-ও নয়। তবে মেনেছে রাজধানীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল প্রতিরোধক ব্যবস্থার একাধিক পর্যায়ে। যেমন—মানসম্মত পিপিই সংগ্রহে, তেমনি সংখ্যাগত সরবরাহে। সেখানে ঘাটতি বড় হয়ে দেখা দেয়। সেটা চিকিৎসক-সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। এটা পূর্বপরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতির অভাবের কারণে।
এ সময় দুটি শব্দ গণমাধ্যমে, সংবাদপত্রে বহুলদৃষ্ট—সমন্বয়হীনতা ও শিথিলতা; এবং তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোকে কেন্দ্র করে। এসবের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সামান্যই দেখা গেছে। এর ফলে করোনা সংক্রমণ যথারীতি বেড়েছে, ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে।
অন্যদিকে প্রতিরোধক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে করোনা সংক্রমণ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রটি যথেষ্ট জটিলতায় জড়িত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে নানা মতভেদ ও ভিন্ন চিন্তা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনা সংক্ষেপ করতে গিয়ে বলতে হয়, যে কথা বরাবর বলি, দেশে মেধার অভাব নেই, অভাব এর যথাযথ সদ্ব্যবহারের। সেখানে নানা অবাঞ্ছিত প্রক্রিয়ার প্রাধান্য দেখা যায়।
এককথায় স্বাস্থ্য খাতে অনেক ঘাটতি—যেমন প্রতিরোধে, তেমনি বাস্তব চিকিৎসাসেবায়। করোনা উপলক্ষে জাতীয় স্বাস্থ্য স্বার্থে উন্নত দেশগুলোর অনুসরণে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এর সুষ্ঠু অবকাঠামোসহ নতুন করে সুগঠিত করা দরকার। দরকার সৎ, দক্ষ, কর্মনিষ্ঠ, মেধাবী পেশাজীবী জনশক্তির সমাবেশ, মেধাবী চিকিৎসক, সেবিকা, ফার্মাসিস্ট ও শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর। এই নতুন নিয়োগ হওয়া উচিত দল-নির্বিশেষে, মেধার ভিত্তিতে।
যেসব মেধাবী তরুণ-তরুণী করোনার জিনোম উন্মোচনে সক্ষম, স্বাস্থ্য খাতের সর্ববিভাগে তেমন মেধাবী ও অনুরূপ দক্ষদের উপস্থিতি চাই। চাই মেধাবী টেকনোলজিস্টসংখ্যা বৃদ্ধির উপযোগী শিক্ষায়তন। দরকার ওষুধসেবার যথাস্থানে মেধাবী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ, এককথায় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উপযোগী পরিকল্পনা ও মজবুত অবকাঠামো। করোনা সংক্রমণ আমাদের এ শিক্ষাই দিচ্ছে। শুধু নতুন চিকিৎসক নিয়োগই যথেষ্ট নয়, তাদের যোগ্যতা ও মেধাই বড় কথা। শেষ কথায় অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ, বাজেটে এই ব্যবস্থার উপযোগী বরাদ্দ, যাতে একটি মজবুত আদর্শ জনবান্ধব স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় বাংলাদেশে। এই প্রয়োজনটা ছিল অনেক দিনের, এখন করোনা তার যথার্থতা প্রমাণ করে দিল।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষা সংগ্রামী