নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) চিকিৎসায় বহুল আলোচিত রেমডেসিভির ও প্লাজমা থেরাপির পক্ষে মত দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। বর্তমানে করোনার কোনো চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন (টিকা) নেই। তবে জোর প্রতিযোগিতা চলছে টিকা আবিষ্কারের।
ডাব্লিউএইচওর গত ৩০ মের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, করোনার অন্তত ১০টি টিকা ক্লিনিক্যাল ইভলুয়েশন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে আছে। এ ছাড়া আরো অন্তত ১২১টি সম্ভাব্য টিকা নিয়ে ‘প্রি-ক্লিনিক্যাল’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের স্কুল অব মেডিসিনের সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টর এপিডেমিওলজিস্ট ডক্টর দিলরুবা নাসরিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি যদি খুব আশাবাদী হয়ে বলতে পারতাম যে আগামী মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন চলে আসবে, তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হতো না। বাস্তবতা হলো, কভিড-১৯-এর টিকা এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। কিন্তু বিজ্ঞানকে আমি ভীষণভাবে তারিফ করি। বিজ্ঞান সুপারসনিক গতিতে ছুটছে ভ্যাকসিনের পেছনে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৪টি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে।’
তিনি বলেন, অন্তত ছয়টি ভ্যাকসিন ‘হিউম্যান ট্রায়াল ফেজে’ (মানুষ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা) চলে এসেছে। ভ্যাকসিন তৈরির অনেকগুলো পর্যায়। গবেষণাগার থেকে শুরু হয়ে ‘প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টেজ’ (জীবজন্তু পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা)-এর জন্য তৈরি হয় প্রতিটি ভ্যাকসিন। মানুষের ওপর পরীক্ষার ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তিনটি ফেজে মানুষের ওপর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়।
ড. দিলরুবা নাসরিন বলেন, মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক একটি ভ্যাকসিন দেওয়ার অনেক ঝুঁকি আছে। ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, কার্যক্ষমতা ও কার্যকারিতা কেমন তা দেখতে হয়। ফেজ ওয়ান, টু ও থ্রি—তিনটি পর্যায়েই যদি পুরোপুরি ভালো ফলাফল পাওয়া যায় শুধু তখন ভ্যাকসিন ‘অ্যাপ্রুভাল ফেজে’ (অনুমোদন পর্যায়ে) যায়।
তিনি বলেন, ২২৪টি ভ্যাকসিনের মধ্যে অন্তত ছয়টি ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ পর্যায়ের ফেজ ওয়ান বা টুতে আছে। এর মধ্যে তিনটি একেবারে ‘ইউনিক’। সেগুলো খুবই ভালোভাবে কাজ করছে।
দিলরুবা নাসরিন বলেন, বেশির ভাগ মানুষ চেনেন অক্সফোর্ডের জেনার ইনস্টিটিউটের স্যারা গিলবার্টকে। তাঁর ভ্যাকসিনকে আমরা বলি ‘ভেক্টর’ ভ্যাকসিন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অ্যাডিনো ভাইরাসের গায়ে কভিড ভাইরাসকে ইমপ্লান্ট করে মানুষের শরীরে ঢোকানো হচ্ছে। এটিকে বহিঃশত্রু মনে করে মানুষের শরীর এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে। সেটি ‘ফেজ ওয়ানে’ আছে এবং ভালো ফলাফল হচ্ছে। এরপর যে ভ্যাকসিনটি সামনে চলে আসবে তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের মডার্না ভ্যাকসিন। এটি খুব নতুন ধরনের ভ্যাকসিন। একে বলে এমআরএনএ ভ্যাকসিন। সেটি কিন্তু ‘সেকেন্ড ফেজে’ চলে এসেছে।
তিনি বলেন, ফেজ ওয়ানে ১০-এর গুণিতক নম্বর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে (সাধারণত ২০ থেকে ৮০ জন) ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ফেজ টুতে শতকের গুণিতকে মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ৬০০ লোকের ওপর এখন পরীক্ষাটি চলছে। ইতিমধ্যে জুলাই থেকে ফেজ থ্রি পর্যায়ের পরিকল্পনা করে ফেলেছে। তখন কয়েক হাজার লোকের ওপর ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করা হবে।
দিলরুবা নাসরিন বলেন, আমি গর্বিত যে আমার সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টও ‘ফেজ থ্রি’ পর্যায়ে ওদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমরা সেটি ট্রায়াল দেব।
তিনি বলেন, ‘ফেজ থ্রি’ ঠিকমতো হয়ে গেলে ভ্যাকসিনটি ‘অ্যাপ্রুভাল’ (অনুমোদন) পর্যায়ে চলে যাবে। ‘ফেজ থ্রি’ সফলভাবে শেষ হলে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সেটি অ্যাপ্রুভাল ফেজে যেতে পারে।
দিলরুবা নাসরিন বলেন, চীনের ক্যানসিও ভ্যাকসিনের কথা না বললেই নয়। সেটি ইনঅ্যাক্টিভেটেড কভিড ভ্যাকসিন। ইনঅ্যাক্টিভেটেড সেল দিয়ে তৈরি। সেটিরও কাজ চলছে। ওটাও ফেজ টুতে চলে এসেছে। ওই তিনটি ভ্যাকসিন আমাদের সামনে আশাপ্রদ ফল দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন, অ্যাপ্রুভাল ফেজের পর উৎপাদন-সরবরাহসহ অনেক বিষয় আছে। উৎপাদনকারী কম্পানিগুলো কাঁচামাল, ভায়াল কনটেইনার নিয়ে প্রস্তুত। সমস্যা হলো ফেজ থ্রি আগে শেষ হতে হবে।
কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন (সেপি), যুক্তরাষ্ট্র, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য এরই মধ্যে অনেক তহবিল দিয়েছে।
দিলরুবা নাসরিন বলেন, করোনাভাইরাসকে আমরা বলি সাম্যবাদী ভাইরাস। কারণ যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারেন। যুক্তরাজ্যের জেনার ইনস্টিটিউট ‘এক্সট্রা জেনেকার’ সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রথম ১০০ কোটি ভ্যাকসিন বোধ হয় যুক্তরাজ্যকে দিতে হবে। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) পুরো বিশ্বকে একসঙ্গে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। কারণ আফ্রিকার একটি দেশে যদি কভিড থেকে যায় তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ কিন্তু নিরাপদ নয়।
এদিকে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অ্যাসেটস সুপারভিশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কমিশন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাটে জানিয়েছে, চীনের তৈরি একটি ভ্যাকসিন এ বছরের শেষ নাগাদ বাজারে আসতে পারে। উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস ও বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টসের উদ্ভাবিত টিকা এরই মধ্যে দুই হাজারের বেশি মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের এপিডেমিওলজিস্ট ডক্টর দিলরুবা নাসরিন বলেছেন, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের জন্য অন্তত ৫৫০ কোটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে হবে। সেই ভ্যাকসিন তৈরি করতে প্রয়োজনীয় সময়টুকু লাগবে। অনেকে খুব আশাবাদী হয়ে চিন্তা করছে আগামী বছরের মাঝামাঝি সবাই ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। আমিও খুব আশাবাদী। তবে বাস্তবতার নিরিখে বলব, করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে দুটি বছর আমাদের ধৈর্য ধরে চলতে হবে। এই সময়টুকুতে আমরা প্রত্যেকে আমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো (শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা) চালিয়ে যাব।
তিনি আরো বলেন, হার্ড ইমিউনিটি পাওয়ার বাস্তবসম্মত একমাত্র উপায় হচ্ছে ভ্যাকসিন। সেটি আবিষ্কার ও প্রয়োগের আগ পর্যন্ত সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে আছে। এ জন্যই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের মতো বড় শহরগুলো ‘স্ট্রিক্ট লকডাউন’ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ডক্টর দিলরুবা নাসরিন বলেন, বাইরে ঘুরে আক্রান্ত হয়ে হার্ড ইমিউনিটি পাওয়ার চেষ্টার ফল অনেক কঠিন হতে পারে। পুরো জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আবার একদিকে প্রচুর মানুষ একসঙ্গে সংক্রমিত হওয়ার কারণে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে অনেক মানুষের মৃত্যুও হতে পারে, যেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।