নতুন অর্থবছরের বাজেট খুব শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। এবারের বাজেটটি একেবারে গতানুগতিক ধারার বাজেট থেকে ভিন্ন ধারার বাজেট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাজেটে সাধারণত যেমন থাকে—কতগুলো অঙ্ক থাকে, কিভাবে রাজস্ব আয় আদায় করা হবে, কোথায় কিভাবে আয় ও ব্যয় করা হবে; এসব নিয়ে কিছু বক্তব্য থাকে। এবারের বাজেট সেভাবে প্রণয়ন করার কোনো সুযোগ নেই। নতুন বাজেটটাকে একেবারেই ঢেলে সাজাতে হবে। এটাকে অ্যাকশন প্ল্যানের মতো বলা যেতে পারে। কথাবার্তা কম বলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী কাজ সম্পন্ন হবে সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করতে হবে। তবে আগের বছরের বাজেটের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে আগের বছরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে আনতে হবে।
নতুন বাজেটে তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, এটাকে মোকাবেলা করার জন্য প্ল্যান থাকতে হবে। বিশ্বমন্দার প্রভাব নিয়ে ভাবতে হবে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, দরিদ্র মানুষের আর্থিক অবস্থাটা মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু সমতাভিত্তিক উন্নয়ন হয়নি, কাজেই প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষকে বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে। একটি জরিপে দেখলাম, দেশের প্রায় ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এই তিনটি খাতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এই বিষয়গুলো এবারের বাজেটে গুরুত্ব দিলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন নয়। আরো দু-তিনটি বাজেটে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। তাহলেই অর্থনৈতিক মন্দা ও প্রভাব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে।
এখন যে বাজেট হয় পরিচালন বাজেট বা রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট, এটাকে আলাদাভাবে না রেখে যদি একটি সমন্বিত বাজেট করা যায়, তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। মোটকথা, এখন সব কিছুই করতে হবে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বাজেট। রাজস্ব বাজেট থেকে যে আয় হয় তার সমস্তই ব্যয় হয় প্রশাসনিক এবং অন্যান্য ব্যয়ে। কিন্তু এটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব বেশি সহায়ক তা মনে হয় না। তাই দুটিকে সমন্বিত করতে পারলে ভালো। তবে এ বছরে এটা এখনই সম্ভব হবে না। হিসাবরক্ষণব্যবস্থা একত্র করতে পারবে না। ক্যাপিটাল ও নন-ক্যাপিটাল খরচ এক করতে পারবে না। এ ধরনের কিছু অসুবিধা আছে। ভবিষ্যতে বাজেটটা প্রণয়ন করতে হবে পরিচালন ও উন্নয়ন দুটিকেই একত্রীভূত করে।
বাজেটের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য, পদক্ষেপ এবং কর্মকাণ্ড যেগুলো হবে, সেগুলো হচ্ছে, প্রথমত শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা খাত এবং কৃষি খাত সচল রাখতে হবে। গতি মন্থর হতে পারে, কিন্তু উন্নয়নটা সচল রাখতে হবে। আমাদের অর্থনীতির যেগুলো প্রকৃত খাত আছে, সেগুলো চালু করতে হবে। বহিঃখাতের জন্য যেগুলো এক্সপোর্ট করা হয় এবং যেগুলো দেশীয় খাত, সেগুলোর ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। কভিড-১৯-এর ফলে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছে, সেগুলোতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার সম্প্রতি যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেটা ব্যাংকনির্ভর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ভর এবং ঋণনির্ভর। এতে বেশির ভাগই মনিটরিং পলিসির ওপর চাপ পড়ছে। বাজেটের যেটা রাজস্বনীতি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটের আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব, সেটা সরাসরি ফোকাস করতে হবে, আমাদের মুদ্রানীতির যে উদ্দেশ্য হবে এবং বাজেটের উদ্দেশ্য—এ দুইয়ে সমন্বয় থাকতে হবে।
আমাদের যে ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট, সেখানে অনেক দুর্নীতি হয়, এর ম্যানেজমেন্ট ভালো নয়। প্রশাসনিক ব্যয়, সরকারি অফিসারের প্রণোদনা, সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এসব ব্যয় কমাতে হবে এবং জনগণের জীবনমান উন্নত করে সরাসরি যেসব খাতে বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
বাজেটে যে কনসেশন দেওয়া হয়, প্রণোদনা দেওয়া হয়, বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরের জন্য—এটা আরো যুক্তি সংগত করতে হবে। একটা বিশেষ রপ্তানি পণ্যে পোশাকশিল্প যখন আমরা নির্ভর করি, তখন কিন্তু অবস্থাটা ভালো হয় না। এসব খাতে বরাদ্দ দেওয়ার ফলে তারা বিদেশি মুদ্রা আনে, কিন্তু সামাজিক উন্নয়ন বিশেষ কিছু হয় না। শ্রমিকের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়। এটা নিয়ে ভাবতে হবে, আবার যেসব শিল্পে নজর পড়ে না, পড়লেও কম, সেগুলোতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
ট্যাক্স জিডিপির হার বাড়াতে হবে। তবে এটা বাড়াতে গিয়ে যেন করের হার বেড়ে না যায়। ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স—কোনো কিছুই বাড়ানো যাবে না। করদাতার সংখ্যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। আরেকটা জিনিস করতে হবে, রাজস্ব বোর্ডকে আরো দক্ষ ও কর্মতৎপর হতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। করদাতারা যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয়, সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে। ভ্যাটের নামে অনেক টাকা আদায় হয়, যেগুলো সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হয় না, এগুলোও দেখতে হবে। নতুন অর্থবছরে ভ্যাট বা করপোরেট ট্যাক্স কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না। কারণ মানুষের আয়-রোজগার সেভাবে নেই। কাজেই এ দিকটা ভেবে দেখতে হবে। যারা ট্যাক্সের বাইরে আছে, তাদের করের আওতায় আনতে হবে। করের জালটা বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজস্ব ব্যয় কমাতে হবে। পরিচালন ব্যয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব ব্যয় হয়, তা কমাতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা এখন বাড়ানো যাবে না। সরকারি খাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে এতে বেসরকারি খাতেও চাপ বাড়ে। জায়গাজমির ক্ষেত্রে শর্ত ও চাপ কমাতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি কমাতে হবে। এটাতে নজর দিতে হবে। এতে দেশের গৃহনির্মাণ খাত উজ্জীবিত হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো যাবে না। জনগণের সঞ্চয় বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় সঞ্চয় ব্যবস্থার ওপর বেশি সুবিধা দিতে হবে।
এখন সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে। পরিবহন খাতে যেমন জরুরিভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে কিন্তু বরাদ্দটা বেশি করা দরকার। সাধারণ কিছু চিকিৎসাসহ অন্যান্য রোগের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা সর্বজনীন করতে হবে। অন্য সব খাতের তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা ভালো করতে পারব না। এই খাতকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। কারিগরি ও ব্যাবহারিক শিক্ষায় প্রাধান্য দিতে হবে। বাইরে আমাদের জনশক্তি পাঠাতে হলে কারিগরি ও ব্যাবহারিক শিক্ষার বিকল্প নেই। দেশে ও বাইরে কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে শিক্ষার নানা দিক নিয়ে ভাবতে হবে। আর সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান তৈরিতে জোর দিতে হবে। কারণ আমাদের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে। যুবকদের জন্য অর্থায়ন করতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে হবে। বাইরের দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যেতে হলে এই খাতগুলোতে বরাদ্দ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক, দিনমজুর—এদের কোনো সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সোশ্যাল প্রটেকশন নেই। এটা চালু করতে সময় লাগবে। পৃথিবীর নানা দেশে এসব আছে। এখানেও ধীরে ধীরে সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং ইনস্যুরেন্স চালু করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা নিয়ে এগুলো করতে হবে।
কৃষি খাত নিয়ে ভাবতে হবে গুরুত্বসহকারে। শস্য, মৎস্য ইত্যাদি খাতে জোর দিতে হবে। ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষি আমাদের সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তা দেয়। জিডিপির উন্নয়নে হয়তো এর ভূমিকা কম। আরেকটি হচ্ছে, কৃষির উৎপাদনের সঙ্গে এর বাজারজাত করার প্রতি জোর দিতে হবে। এই খাত খুব সমস্যায় থাকে। কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন করে কিন্তু বাজারজাত করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। বাজারজাত সমস্যার কারণে দালালরা এসে কম দামে পণ্য নিয়ে যায়। ফলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পায় না।
সরকারের নিজস্ব যেসব এন্টারপ্রাইজ আছে রাজস্ব আয়ের বাইরে, সেগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বিমান থেকে শুরু করে রেল—রাজস্ব ঘাটতি পূরণে এগুলোতেও নজর দিতে হবে। সহজ সুদে বহির্বিশ্বের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিতে পারে। দেশীয় ব্যাংকের বাইরে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। কোন খাত অর্থনীতিতে ভালো করছে, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বাজেটে এবার কোনোভাবেই অপচয় হয় এমন খাতে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়েও জোর দিতে হবে। অতীতের বাজেটের দুর্বল প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন এর পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : মাসউদ আহমাদ