সিন্ডিকেটের স্বার্থ না দেখায় সরে যেতে হয়েছে: ডা. শহীদউল্লাহ

মত ও পথ রিপোর্ট

ডা. শহীদউল্লাহ

সোমবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আদেশে পরিচালক পদ থেকে শহীদউল্লাহকে দায়িত্ব থেকে অবমুক্ত করা হয়। নতুন পরিচালকের কাছে তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। এর আগে গত ২২ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশে অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে সিএমএসডির পরিচালক পদে নিয়োগ দেয় সরকার।

বেসরকারি ওই টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করার জন্য অনুরোধ আসে সদ্যবিদায়ী পরিচালকের কাছে। তিনি তা আমলে নেননি বলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন।

ডা. শহীদউল্লাহ বলেন, এন৯৫ মাস্ক সরবরাহের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা না চেয়ে একপাক্ষিকভাবে সিএমএসডির কাছে দোষ চাপানো হয়েছে। তাহলে এর দায় কার? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বলব যে সম্পূর্ণ সেই প্রতিষ্ঠানের (জেএমআই) ওপর বর্তায়। যখন আমাদের নজরে আসে বিষয়টি, হাসপাতাল থেকে সাথে সাথে সেগুলো তুলে নিই।’

এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘জেএমআইকে আমরা সাথে সাথে চিঠি দিই। জানতে চাই কেন এই মাস্ক তারা সরবরাহ করেছে। তখন তারা ভুল স্বীকার করে। সাথে সাথে আমরা বিষয়গুলো জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিই, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’

কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটার দায়িত্ব সিএমএসডির। শুরুতেই এন৯৫ মাস্ক নিয়ে আলোচনায় আসে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাখ্যা পাল্টা ব্যাখ্যার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা পড়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। ফলাফল হিসেবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের বদলি করা হয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠনগুলো মনে করে প্রথাভঙ্গ করে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের একজনকে সরিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে বসানো হয়। যার বিরোধিতা করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদও (স্বাচিপ)।

গত ২৩ মে জনপ্রশাসন সচিবকে লেখা যৌথ চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ অবগত হয়েছে যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসন ক্যাডারের একজন অতিরিক্ত সচিবকে পরিচালক, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ পদে প্রেষণে নিয়োগ করা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যাবতীয় চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। আমাদের জানামতে আজ পর্যন্ত উক্ত পদে চিকিৎসক কর্মকর্তা ব্যতীত কখনোই কাউকে পদায়িত করা হয় নাই।’

বিএমপি সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী এবং স্বাচিপ সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান এবং মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘নিকট অতীতে উক্ত পদে সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক কর্মকর্তাগণই ধারাবাহিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে এই পদে নিয়োগ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং ইহা একটি অশনি সংকেতের ইঙ্গিত বহন করছে।’

জানতে চাইলে ওইদিন স্বাচিপ সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘সিএমএসডির পরিচালক পদটি টেকনিক্যাল পদ। এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী অধিদপ্তরের যত পরিচালকের পদ আছে সব টেকনিক্যাল পদ। এই পদগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে টেকনিক্যাল লোকদের নিয়োগ দিয়ে আসা হচ্ছে। হঠাৎ করে প্রশাসন ক্যাডার থেকে সিএমএসডির পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে চিঠিতে আমাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।’

স্বাচিপের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘সরকার মনে করলে যেকোনো পদ থেকে কাউকে সরিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেটা টেকনিক্যাল পদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অংশ। এখানে প্রশাসন ক্যাডারের লোক ঢোকানোটা আমরা মনে করি বড় ধরনের পদক্ষেপ। আমরা এখানে কিছু একটার আলামত মনে করি। সে জন্য এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছি।’

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, এই পদায়ন আইন মেনেই করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথা তো ভঙ্গ করতেই পারি। আইনে কিনা তাই বলেন। ম্যানেজেরিয়াল ক্যাপাসিটির একজন লোক দরকার। আর পরবর্তীতে যদি মনে করি ওটা কিছু করতে হবে করা যাবে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদউল্লাহ দাবি করেন, তাকে এভাবে বদলি করে দেওয়ার কারণ ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘এখানে আমি যখন আসি তখন অনেকেই বলেছেন, এখানে অনেক সিন্ডিকেট আছে। বিভিন্ন উচ্চস্তর থেকে আমার প্রতি অনুরোধ ছিল যে তাদের দ্রব্যাদিসমূহ ক্রয়ের, সেগুলো আমি আমলে আনি নাই।’

সিএমএসডির সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘যখন তারা দেখলো যে তাদের কোনো স্বার্থ এখানে উদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখনই আমাকে…। এটা আমি অনুমান করছি।’

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ এবং হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় একটি সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরে বেশ কয়েকটি দপ্তরে চিঠিও পাঠান সাবেক পরিচালক। সেখানে বলা হয়, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলের অনুরোধ রয়েছে এবং লিস্ট বা প্রাইস লিস্ট অনুযায়ী কেনাকাটা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ এই তালিকাটি দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) সিরাজুল ইসলাম।

এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। উনি (শহীদউল্লাহ) হয়তো বলতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি আমাকে কপি না দেন, তাহলে এটা কনফার্ম করে না। আমাকে তিনি কপি দিলে আমি অবশ্যই অবজেকশন দিতাম। যাওয়ার সময় কত কথাই বলতে পারে।’

ওই চিঠিতে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সময়ের প্রভাবশালী পুরনো সিন্ডিকেটের নামও উঠে আসে। সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক বলেন, ‘যদি আমরা বলি যে মিঠুগ্রুপ। তার বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে, নামে বেনামে। প্রতিবছরই তারা পরিবর্তন করে। আমি স্বাভাবিক ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুলো আমলে নিই না।’

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার কথাও বলেন তিনি। বলেন, ‘পিপিই, হেড কাভার, এন৯৫ মাস্ক, স্যানিটাইজার, বুট এগুলো যদি হিসাব করি তাহলে এখন পর্যন্ত এর দাম আটশ কোটি টাকার ওপরে আসে। সেখানে আমি বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র ১০০ কোটি টাকা।’

কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর চিকিৎসকদের জন্য সরবরাহ করা এন৯৫ মাস্কের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আলোচনায় আসে সিএমএসডি। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভিডিও কনফারেন্সে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। যারা এসব অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে