বিশ্বের বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা কমন যে কথাটি এখন বলছেন, তা হলো মানবজীবনযাত্রা এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ব্যবস্থা আর আগের মতো থাকবে না। মুদি দোকান থেকে শুরু করে বিমান ভ্রমণ এবং পার্লামেন্ট সেশন ইত্যাদি কাজ করোনার সূত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে চলবে তার জন্য নতুন বিন্যাসে সাজানোর কাজ সব দেশ শুরু করে দিয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে, করোনার সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে, উপায় নেই। করোনার বিপর্যয় কেন এবং কোথা থেকে কী হলো তার তত্ত্ব-তালাশ শুরু হয়েছে। কমন সীমান্ত এবং চীনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম অত্যন্ত সফলভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অনেক দূরের ও উন্নত দেশ ইতালি, স্পেনসহ অন্যান্য দেশ এবং আরো দূরের আমেরিকা কেন এমন নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়ল। সংগত কারণেই এ প্রশ্ন উঠেছে। আপাতত মনে হচ্ছে, অতি আত্মতুষ্টি, অতিমাত্রার উন্নাসিকতা এবং চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা ও লাগামহীন স্বাধীনতার পরিণতি কী হতে পারে তার সামান্য একটা উদাহরণ হয়তো করোনার মাধ্যমে সৃষ্টি হলো। করোনার উৎপত্তি স্থল ১৩০ কোটি মানুষের দেশ চীন বিশ্বকে বুঝিয়ে দিল তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও লাইফ স্টাইলই শুধু এমন দুর্যোগে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। ফলে চীনের সব কিছুর বিরোধিতাকারী আমেরিকা বেজায় খেপেছে চীনের ওপর। আগামী নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীন হবে অন্যতম বড় ইস্যু।
দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভিয়েতনামের করোনা নিয়ন্ত্রণ থেকে বোঝা যায় এবং আমেরিকার মূলস্রোতের বড় মিডিয়া হাউসগুলোর আলোচনার দিকে দৃষ্টি দিলেও জানা যায় করোনার লাগামহীন বিস্তার ও লাখো মানুষের মৃত্যুর জন্য সবাই ট্রাম্প প্রশাসনের চরম অদূরদর্শিতা এবং অতি আত্ম অহমিকাকেই দুষছেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন এখন চীনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে এই মর্মে যে চীনই এই করোনার জন্য দায়ী এবং চীন ইচ্ছাকৃতভাবেই এটিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। চীন যদি আন্তর্জাতিক তদন্তে বাধা দেয়, তাহলে চীনকে চরম মূল্য দিতে হবে। দেখে নেওয়া হবে, জবাবদিহি করতে হবে ইত্যাদি হুমকিও দিচ্ছে আমেরিকা। চীন আন্তর্জাতিক তদন্তসহ সব অভিযোগ অত্যন্ত কড়া ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। হংকংয়ের প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে এমনটাই চীন মনে করছে। করোনাভাইরাস ও হংকং ইস্যু ছাড়াও চীনের টেকনো জায়ান্ট হুয়াউই, বাণিজ্য যুদ্ধ, উইঘুর, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুগুলো নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত আগামী দিনে আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে এসব কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে চীন নিজের লক্ষ্য অর্জনে একের পর এক নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। হংকংয়ের জন্য নতুন আইন পাস করে ফেলেছে। সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়, তাইওয়ানকে একত্র করার কৌশল হিসেবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সঙ্গে বিকল্প হিসেবে শান্তিপূর্ণ পন্থার কথাটি আগের নীতিমালায় থাকলেও সম্প্রতি চীন পার্লামেন্টের নতুন প্রস্তাবে শান্তিপূর্ণ কথাটি বাদ দিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে ঐতিহাসিক লিগ্যাসির সূত্রে দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা চীন-ভারত সীমান্তের লাদাখ ও ভুটানের নিকটবর্তী ডোকলাম এলাকায় চীন নতুন করে ব্যাপক সৈন্যের সমাবেশ এবং নতুন নতুন সামরিক স্থাপনা তৈরি করছে, যা দুই দেশের অন্তর্বর্তী সীমান্তরেখা, লাইন অব কন্ট্রোলের স্ট্যাটাস সমতাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে বলে ভারত থেকে বলা হচ্ছে। সংগত কারণে ভারত ও তার সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কথা উঠেছে, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ও তিব্বতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি, যেটি চীন স্বীকার করে না, তা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং বহুবার সীমান্ত সংঘর্ষের কারণ হলেও ১৯৬২ সালের পর দুই দেশই যুদ্ধ এড়িয়ে চলেছে, তাহলে করোনার সময় নতুন করে পুরনো সংকটকে জাগিয়ে তোলা কেন। এর উত্তরে দুই পক্ষ যা বলছে তার চেয়ে অন্তর্নিহিত কারণ ভিন্ন। বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, চীন ভারতকে বার্তা দিতে চাইছে করোনাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয়ে আমেরিকার প্রস্তাবে ভারত যেন সমর্থন না করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তাইওয়ানের সদস্য হওয়ার পক্ষে ভারত যেন ভোট না দেয়। আপাতত দুই দেশের পরিপক্ব নেতৃত্ব হয়তো একটা সমঝোতায় আসবে বলে মনে হচ্ছে। তবে করোনার পর এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিষয়গুলো আবার ভিন্নভাবে সামনে আসবে। সুতরাং করোনার ধাক্কায় যেমন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, তেমনি বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও বিশ্বায়নও নতুনরূপে আবির্ভূত হবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikdar52@gmail.com